প্রচ্ছদ

লকডাউনে থমকে গেছে দেশের একমাত্র প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত বাবুরহাট

  |  ১৩:৪৮, এপ্রিল ২৩, ২০২১
www.adarshabarta.com

Manual4 Ad Code

বোরহান মেহেদী, নরসিংদী থেকে :

লকডাউনে থমকে গেছে প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার শেখেরচর-বাবুরহাট। এখানে প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্বাহের পথ। টানা দু-সপ্তাহের কঠোর লকডউনের ফলে সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ক্রেতারা আসতে পারছেনা হাটে।

এছাড়া অনলাইনে বেচাকেনা চালু থাকলেও তেমন একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ইদ মৌসুমে ছোট ছোট দোকান মালিক, কর্মচারী ও কাপড়ের গাইট টানার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে।

নরসিংদী সদর উপজেলার শেখেরচর বাজারটি প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত বাবুরহাট নামে পরিচিত। স্থানীয় জমিদার হলধর সাহা ১৯৩৪ সালে নিজের প্রায় ১১ একর জমিতে বাজারটি প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। এটি দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার।

এমন কোন কাপড় নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। বাবুরহাটে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন হাজারের অধিক বিভিন্ন ধরনের পাইকারি কাপড়ের দোকান রয়েছে। এখানের কাপড় দেশের মানুষের প্রায় ৭০ ভাগ দেশিয় কাপড়ের চাহিদা পূরণ করে। ৮৭ বছরের পুরনো পাইকারি এই কাপড়ের হাটে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় কোটি কোটি টাকার কাপড়। বছরের অন্যান্য সময় প্রতি সপ্তাহে বেচা-কেনা হয় ৫ থেকে ৭শ কোটি টাকা।

বুধবার বিকাল থেকে জমতে শুরু করে বাবুরহাট। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পুরো দমে চলে হাট। শনিবার বিকেলে শেষ হয় হাটের সকল বেচাকেনা। এ সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি ও কুলিদের হাঁকডাকে সরব থাকে পুরো হাট এলাকা। ঈদ মৌসুমে বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতা মিলিয়ে ৫/৭ লাখ।

বাবুরহাটে বিক্রি হওয়া থানকাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, সুতি, শাড়ি, থ্রি-পিস, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার তাঁতশিল্পে উৎপন্ন। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত নাইট কুইন, দেশিয় জর্জেট, লেজার জর্জেট, জাপানি সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, কাতানসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ের সম্ভারে বাবুরহাট হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময়।

Manual5 Ad Code

২৩ এপ্রিল শুক্রবার সরেজমিনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠা নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাট ঘুরে দেখা গেছে, চলমান লকডাউনের ফলে বাবুরহাট বাজার নিরব-নিস্তব্ধ ও জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা, নেই কোন শোরগোল, বন্ধ রয়েছে হাটের সকল দোকানপাট। প্রতিটি দোকানের সার্টারে ঝুলছে বড় বড় তালা। অনেক দোকানী হাটে আসলেও দোকান খুলতে দেখা যায়নি।

এ সময় উপস্থিত অনেক দোকানদার বলেন, লকডাউনের কারণে বাস ও ট্রেনসহ পাবলিক পরিবহনগুলোর চলাচল বন্ধ থাকায় আশপাশের জেলাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে হাটে কোন পাইকারি ক্রেতা আসতে পারছে না। এ অবস্থায় দোকান খুললেও কোন বেচাকেনা হবে না।

মনির আহমেদ নামে এক ছাঁপা কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না, তাই কাপড়গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখতে ঘুরতে ঘুরতে হাটে চলে এসেছি। বছরের এগারটি মাস লাভ-লোকসানের মধ্যদিয়ে আমরা ব্যবসা পরিচালনা করলেও অপেক্ষায় থাকি ঈদ মৌসুমের এই একটি মাসের জন্য। কিন্তু দেশের মহামারি করোনা পরিস্থিতির জন্য সরকার ঘোষিত লকডাউনে আমাদের সব আশা আকাঙ্খা ভেস্তে গেছে। বর্তমানে আমাদের জীবন জীবিকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেশ কয়েকটি গলি ঘুরে আদূরি ফেব্রিক্স নামে একটি দোকান খোলা দেখে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেই জানা যায়, পুরাতন দোকান ছেড়ে তারা নতুন দোকানে মালামাল সরিয়ে আনছে। সেজন্যই দোকান খোলা রয়েছে। দোকান মালিক জানায়, নতুন দোকানে মালামাল সরিয়ে আনার জন্য তাদের দোকান খোলা থাকলেও সকাল থেকে এ পর্যন্ত (বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ) কোন পাইকারের চেহারার দেখা মিলেনি।

Manual1 Ad Code

বাবুরহাটে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত থাকা কয়েকটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সামনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে উপর দাঁড়ানো কয়েকটি ট্রাকে মাল ভর্তি করতে দেখা যায়।

Manual3 Ad Code

এ সময় শিকদার ট্রাভেলস এর মালিক মামুনের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনলাইনে অর্ডারকৃত কাপড় তারা পরিবহন করছেন। চলতি ঈদ মৌসুমে অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রতিদিন তারা ১০/১২ ট্রাক কাপড় দেশে উত্তরাঞ্চলে পাঠাতো অথচ এ বছর লকডাউনে তা সম্ভব হচ্ছে না। সারাদিনে এই একটি ট্রাক পাঠাচ্ছে তাও ক্রেতা না থাকায় পুরো লোড করা সম্ভবপর হচ্ছে না।

তিনি বলেন, চলমান এই লকডাউনে স্বল্প পরিসরে বাবুরহাট খুলে দিলে দোকান মালিক, কর্মচারী, শ্রমিক ও আমরা ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীরা পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারতাম।

শেখেরচর-বাবুরহাট বাজার বনিক সমিতি কার্যালয়ে গিয়ে সমিতি কোন কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। শুধু মাত্র কয়েকজন পুলিশ সদস্য বসে আছেন। এ সময় বেশ কয়েকজনকে ফোন করার পর সমিতির ক্রীড়া সম্পাদক মোখলেছুর রহমান আমাদের অনুরোধে কার্যালয়ে আসেন।

তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে শেখেরচর-বাবুরহাটে লকডাউন চলছে। গত সপ্তাহে লকডাউন এতোটা কঠোর না হওয়ায় দেশে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি ক্রেতারা বাজারে আসতে পেরেছিল তাই বাবুরহাটের দোকানপাট স্বল্প পরিসরে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫ পর্যন্ত খোলা রাখা হয়েছিল।

কিন্তু এ চলতি কঠোর লকডাউনে সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা হাটে আসতে পারছেনা। বাবুরহাটে অনলাইনে কাপড় বেচাকেনার প্রচলন শুরু হয়েছিল গত বছর থেকে।

Manual8 Ad Code

গত বছর করোনা পরিস্থিতির ফলে বাজার বন্ধ থাকায় প্রাথমিক অবস্থাতে অনলাইনে আমরা অল্প-স্বল্প বেচাকেনা করতে পেরেছি। কিন্ত চলমান লকডাউনে অনলাইনে বেচাকেনার সুযোগ থাকলেও তেমন একটা সারা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গত হাটে অনেক ব্যবসায়ীই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য এরই মধ্যে কিনে নিয়ে গেছেন।

তিনি জানান, বাবুরহাটে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের অধিক বিভিন্ন ধরেনের কাপড়ের দোকান বসে। এই দোকানগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার লোক কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বাজার বন্ধের কারণে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দোকানে খেটে খাওয়া ওইসকল কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতি ইদ মৌসুমে বাবুরহাটে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার কাপড় বেচাকেনা হয়। কিন্তু এ বছর তা মাত্র এক হাজার কোটিতে নেমে আসবে বলেও তিনি আশংকা করেন।

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code