প্রচ্ছদ

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আব্দুল ওদুদ (বিএসসি) স্মরণে

  |  ০২:৪২, আগস্ট ০২, ২০২২
www.adarshabarta.com

 

তাজ উদ্দিন আহমদ:

গত ২০ জুলাই ২০২২ বিশ্বনাথ পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের রামধানা গ্রামের কৃতিসন্তান জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি তাঁর নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন—–)। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল আশি (৮০) বছর। অত্যন্ত সৎ নির্লোভ রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি স্বাধীনতা উত্তর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। সিলেট জেলা জাসদের একজন দায়িত্বশীল নেতা হওয়ার/থাকার জন্য ‘৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তিনি সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হন। তৎকালীন সামরিক সরকারের আমলে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো আদর্শচ্যুত হননি।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর একাধিক সামরিক সরকারের আমল ছাড়াও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করার জন্য নতুন নতুন রাজনৈতিক দল ও জোট গঠন করা হয়েছে। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক বাঘা বাঘা নেতা আদর্শিক রাজনীতির তোয়াক্কা না করে দলত্যাগ করে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সেই সব নতুন দল ও জোটে যোগদান করেছেন। একজন জেলা পর্যায়ের নেতা হিসেবে জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসিও ওদের মত আর্থিক ও রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারতেন, কিন্তু প্রগতিশীল এই রাজনীতিবিদ কোনো ধরনের রাজনৈতিক কিংবা আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য কখনো দলবদল করেননি কিংবা অন্য কোন দলে সরাসরি যোগ দেননি। যদিও তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। চাইলেই তিনি দলবদলের মাধ্যমে তাঁর সে আর্থিক দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারতেন, পাশাপাশি রাজনৈতিক ভাবেও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারতেন। এখানেই তাঁর সাথে অন্যদের পার্থক্য।
জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি’র নেতৃত্বে আমার সর্বপ্রথম কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮২-৮৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি সেসময় শিক্ষকতা ছেড়ে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ইউনিয়নের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহ স্থানীয় যুবকদের সংঘবদ্ধ করে তাদের সাথে নিয়ে এলাকার একটি সংঘবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের এলাকার আরও এক গুণিজন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব আবুল হাশেম বি এসসি কে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য প্রভাবিত করেছিলেন। আমরা তাঁর নেতৃত্বে জনাব আবুল হাশেম বি এসসি র পক্ষে কাজ করেছিলাম। তখন তাঁর সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে ছিলাম পাশাপাশি তাঁর নেতৃত্বগুণ সম্পর্কেও একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মেছিল। যদিও এনির্বাচনে একটি ভোট কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হওয়ায় জনাব আবুল হাশেম বি এসসি জয়লাভ করতে সক্ষম হননি। জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি ছিলেন একজন সুশিক্ষক । স্থানীয় রামসুন্দর অগ্রগ্রামী উচ্চ বিদ্যালয়সহ একাধিক উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন।

এলাকায় শিক্ষা বিস্তারেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। স্থানীয় আশুগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে উত্তর বিশ্বনাথ আমজদ উল্লাহ ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে উনার সাথে আমার দ্বিতীয়বার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ কৃত বা অধ্যয়ন রত সে এলাকার সিনিয়র/জুনিয়র ভাইদের সাথে আমার সুসম্পর্ক থাকার সুবাদে কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল আমি ছিলাম সেই কমিটির একজন নগন্য সদস্য। কলেজ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে সে এলাকার বিভিন্ন গ্রামে কিছুদিন কাজ করার পর বুঝতে পারলাম অত্র এলাকায় জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি’র বেশ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিশেষ করে কলেজের আশপাশ এলাকায় উনার চাচা পীরে কামেল মরহুম শাহ্ আশরাফ আলী সাহেবের অনেক ভক্ত ও মুরিদান থাকায় উনাকে আমাদের সাথে নিলে এ অঞ্চলে কলেজের জন্য কাজ করা আরো সহজ হবে। পরবর্তীতে কলেজের একটি মিটিংয়ে উনাকে সাথে নিয়ে আমি হাজির হলাম। সবাই উনাকে স্বাদরে গ্রহণ করলেন। তিনিও কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে নিজেকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করে ফেললেন। জনাব আব্দুল ওদুদ উত্তর বিশ্বনাথ আমজদ উল্লাহ কলেজের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি। মৃত্যুর কিছুদিন আগ পর্যন্তও তিনি কলেজের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ উনার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ২০০০ সালে।

মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমাদের এলাকার কৃতিসন্তান বিশ্বনাথ কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রভাষক অকাল প্রয়াত জনাব আব্দুল মালেক ভাইয়ের আকষ্মিক মৃত্যুর পর। মালেক ভাই এলাকায় নম্র ভদ্র অমায়িক একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার অকাল মৃত্যু মানুষের মনে রেখাপাত করেছিল। এলাকার অনেকের ইচ্ছে ছিলো মালিক ভাইয়ের জন্য যেন একটা কিছু করা হয়। আমরা এলাকার লোকজনদের নিয়ে বসলাম, একটি শোক সভা করার জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করলাম। । সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি এবং আমাকে করা হয়েছিল সদস্য সচিব। পাশাপাশি এই কমিটির মাধ্যমে একটি স্মরণিকা প্রকাশ এবং মালিক ভাইয়ের স্মৃতিকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তাঁর নামে একটি স্মৃতি পরিষদ গঠন ও একটি পাঠাগার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যদিও তখনকার প্রেক্ষাপটে এই কাজগুলো করা খুব সহজ ছিল না। অনেক বাঁধা-বিপত্তি সত্ত্বেও জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি’র দৃঢ়তা ও আমাদের এলাকার আরেক রাজনীতিবিদ প্রয়াত মালেক ভাইয়ের রুমমেট জনাব এম ইলাছ আলীর সর্বাত্বক সহযোগীতার কারণে আমাদের নেয়া সকল উদ্যোগ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।

জনাব আব্দুল ওদুদ বি এসসি অত্যন্ত সাহসী একজন লোক ছিলেন। কোনো ধরনের বাধা-বিপত্ত্বি বা প্রতিবন্ধকতা তাঁকে কখনও লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি।আমার পেশাগত কারণে সিলেটে অবস্থান করায় বিগত কয়েক বছর যাবত তার সাথে আর আগের মতো সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। আমার বাড়ীর কাউকে পেলে উনাকে দেখতে যাওয়ার জন্য বলতেন। দু-একবার খবর পেয়ে দেখতেও গিয়েছিলাম।

বাড়িতে গেলে আপ্যায়ন করানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ -আলোচনা করতেন। এইবার অসুস্থ হওয়ার পর অনেক দেরিতে খবর পেয়েছি। জীবিত অবস্থায় তাঁকে দেখার আর সুযোগ হয়নি। এ মনোবেদনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সব শেষে সকল সীমাবদ্ধতা ও অপারগতার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রিয় ওদুদ ভাই। পরপারে ভালো থেকো এ কামনা করি নিরন্তর। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আপনার সমস্ত ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে বেহেস্তের সর্বোচ্চতম স্থান জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন এ প্রার্থনা করি।

আমিন।।

 

তাজ উদ্দিন আহমদ

ভাইস প্রেসিডেন্ট,  প্রাইম ব্যাংক,  ব্যবস্থাপক, আম্বরখানা আইবিবি, সিলেট।