প্রচ্ছদ

জুয়েল আহসান কামরুল এর দেশে বিদেশে

  |  ০২:৫৬, জুলাই ০৭, ২০২২
www.adarshabarta.com

 

দেশে বিদেশে :- জীবনের ভেতরে সাহিত্য, সাহিত্যের ভেতরে জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং একটি অন্তর্নিবিষ্ট পাঠোন্মোচন

#সাইফুর রহমান কায়েস#

ভ্রমণ বিষয়ক বইপত্র আমার খুব ভালো লাগে। আমার হাতের অঙ্গুলে এখন জুয়েল আহসান কামরুল ভাইয়ের দেশে বিদেশে বইটি। জুয়েল ভাই একাধারে লেখক, অভিনেতা ও পর্যটক । ডক্টর সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো অগাধ পান্ডিত্যপূর্ণ সাহিত্যিক যিনি একাধারে শিক্ষক, সুরসিক, বহুভাষাবিদ, কবিগুরুর সাগরেদ, পর্যটক এমনি আরো অনেক গুণে গুণাণ্বিত। তার ভ্রমণ বিষয়ক বইপত্র আমি ভালোবাসি। নাওয়াখাওয়া ভুলে একসময় গেছে তার সৃষ্টিসম্ভারে মজেছিলাম। আমাদের আরেকজন বিখ্যাত, প্রিয় লেখক ডক্টর মঈনুস সুলতান ভাই। তার লেখা ভ্রমণ বিষয়ক যেকোনো লেখা আমি মিস করি খুব। তাদের বর্ণণার ধারাবাহিকতা আমাকে আকৃষ্ট করে রাখে।
আমি যখন পদ্মাপারের লেখক জুয়েল আহসান কামরুল ভাইয়ের দেশে বিদেশে বইটি পড়ছি তখন তাকে আরেক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেই মনে হচ্ছিলো, আরেক মঈনুস সুলতান বলেই মনে হচ্ছিলো। জীবনের ভেতরে সাহিত্য সৃষ্টি এবং সাহিত্যের ভেতরে জীবনকে অন্বেষণ করার যে দুর্দম্য বাসনা লালন করে চলেন লেখক জুয়েল আহসান কামরুল দেশে বিদেশে বইটি যেনো তারই প্রতিচ্ছবি।
জীবনের কথা বলে সাহিত্য। সাহিত্যকে জীবনমুখী করে তোলার চেষ্টায় তিনি লিখেছেন হটডগ গল্পটি। নিজেদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে আকড়ে ধরতে তিনি অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন এখানে। আবার তিন দশকের বেশি সময় ধরে জাপানের অভিবাসী জীবনে লব্ধ অভিজ্ঞতাকে তিনি অভিজ্ঞানে পরিণত করেছেন। আমরা দেখি এই সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ দেশপ্রেমের ছায়ায় বিকশিত হতে। আত্মরক্ষার সকল কৌশলকে রপ্ত করে একে যে জাপানীরা আত্মবিকারে পরিণত করে নি, শিল্পের স্তরে নিয়ে গেছে সেটিও তিনি এখানে তাদের নম্রতার স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে লেখাটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার ঘটিয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থটিতে। শুকরের মাংসের তৈরী হটডগ খেতে না চেয়ে উপোস করা আর আমার ম্যানিলায় ম্যাকডোনাল্ডে হ্যামবার্গার খেতে না চাওয়ার মাঝে অভূতপূর্ব সাযুজ্য ঘটে যাওয়ার মাঝে সাহিত্য সৃষ্টির সার্থকতাকে আমরা দেখতে পাই।

নিজের বাল্যস্মৃতিকে চকলেট গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করে মাটির সাথে নিজের যোগসূত্রকে আরো নিবিড়ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি লিখছেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন চকলেট কি জিনিস তা আমরা অনেকেই বুঝতাম না। সপ্তাহে পাচ পয়সা, দশ পয়সা দিয়ে একদিন বড়জোর দুয়েকটি ক্যান্ডি কিনে শান্ত্বনা খুজতাম। চকলেট বলতে তখন আমরা বুঝতাম কিটকাট, স্মার্টস জাতীয় কিছুকে। যা ছিলো শহরের ধনী বাবার সন্তানদের খাদ্য।
আমরা চকলেট পাই নি, তাই খাই নি।
নিজের জীবনকে এমন সরলরেখায় প্রতিস্থাপন করতে কয়জন পারে? আমার নিজের শৈশবে হাকিম চকলেট, কাঠি লাগানো লাল লেবেনচুষ খেয়েছি। ওটাই ছিলো পরম পাওয়া। দামী চকলেটের প্রচলন তখনো শুরুই হয় নি।

নিজের জীবনকে তিনি সবার জন্য উম্মুক্ত করেছেন এভাবেই। কেউ কেউ হয়তো নিজেকে অভিজাত প্রমাণের চেষ্টায় মিথ্যা কল্পকাহিনী জুড়ে দেন। লেখক হিসেবে জুয়েল তা না করে নিজেকেই শুধু নন, পুরো জাতিকে মহান করে তুলেছেন।
নিজের দীর্ঘ পরিযায়ী জীবন এখানে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। প্রতি পরতেই তার ছাপ পাওয়া যায়। অহেতুক শব্দের বেড়াজালে জড়িয়ে বক্তব্যকে দীর্ঘায়িত করার প্রবণতা থেকে অত্যন্ত সচেতনভাবে নিজেকে সরিয়ে পরিমিতিবোধের মাধ্যমে তার বইটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছেন। যার ফলে আমরা এক অন্তর্নিবিষ্ট পাঠোন্মোচনে আগ্রহী হয়ে উঠি।
তার বইটিতে শিশুদের স্বভাব শীর্ষক অধ্যায়ের ১২৫ পৃষ্ঠায় সাহিত্য সৃষ্টিতে অহেতুক পাণ্ডিত্য এড়িয়ে যাবার পরামর্শে তিনি বলছেন, আমাদের দেশে আমরা যেমন কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ করে সাহিত্যের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে থাকি। এদেশে তেমন কাঞ্জির পাণ্ডিত্য দেখাতে অনেকেই পছন্দ করেন। একজন জাপানিকে সাধারণভাবে সবকিছু পড়ার জন্য কমপক্ষে দুহাজার কাঞ্জি জানতে হয়।
এই কাঞ্জির সাথে চায়নিজ উচ্চারণের মিল রয়েছে বলে জানাচ্ছেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেটি পাল্টে জাপানি আদল গ্রহণ করেছে। ফলে এখন তারা নিজস্ব ঢঙে কাঞ্জি উচ্চারণ করে থাকেন।
ভাষার গতিপথ বদলে যাবার দিকে তার পর্যবেক্ষণ একজন ভাষাবিজ্ঞানীর মতো।
বাঙালি নিজেকে বেশি বিদ্বান প্রমাণের জন্য বাংলার সাথে ইংরেজি ঘুলিয়ে কথা বলে একটি অভিনব খিচুড়িভাষা সদৃশ কথ্যরীতির জন্ম দিয়ে ভাষাকে রোগাক্রান্ত করে ফেলেছে। তার বক্তব্যে এই ব্যাধিমন্দির থেকে বেরিয়ে আসারও প্রেরণা পাওয়া যায়।
যোগাযোগের অবাধলভ্যতার কারণে আমরা যেমন আরিগাতো শব্দটি জানি, জাপানীরাও স্বাগতম শব্দটি জেনে গেছে অভ্যর্থনার সমার্থক হিসেবে। বইটির বারো পৃষ্ঠায় তিনি বলছেন, অকস্মাৎ জাপানি এক হাস্যোজ্জ্বল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আসসালামু আলাইকুম । এবার বাংলায় জিজ্ঞেস করলো- আপনি কি বাংলাদেশি?

দেশেবিদেশে বইটি যতোই পড়ছি ততোই প্রাণিত হচ্ছি। পাঠকসমাজ আশাকরি বইটি পড়তে প্রলুব্ধ হবেন। বারবার পড়বেন। চায়ের কাপে ঝড় তুলবেন। আরো মনোযোগ দিয়ে বইটি পাঠ করবেন। বইটির প্রকাশ করেছেন বইপত্র প্রকাশনী, প্রকাশক মাহবুবুর রহমান বাবু। মুদ্রিত মূল্য ৩০০ টাকা। প্রকাশকাল অমর একুশে বইমেলা ২০১৬।
আমরা বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলেই মনে করছি।