প্রচ্ছদ

চিলমারীর বন্দর: ভাওয়াইয়ার ব্যাখ্যা -হাসনাত মুহ: আনোয়ার

  |  ০২:২৬, জুলাই ০৫, ২০২২
www.adarshabarta.com

 

চিলমারীর বন্দর: ভাওয়াইয়ার ব্যাখ্যা
-হাসনাত মুহ: আনোয়ার

ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে .॥

যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মর ঝুইরা রয় রে ..
ওকি গাড়িয়াল ভাই…
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে রে ।।

আর…কি কব দুস্কের ও জ্বালা…গাড়িয়াল ভাই
গাঁথিয়া চিকন মালা রে… ( ২বার )
ওকি গাড়িয়াল ভাই…
কত কাঁদিম্ মুই নিধুয়া পাথারে রে ॥

ওকি গাড়িয়াল ভাই…
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে
ওকি গাড়িয়াল ভাই…হাঁকাও গাড়ি তুই
চিলমারির বন্দরে রে ॥
[•প্রচলিত ভাওয়াইয়া গান•]
কথা ও সুর: প্রচলিত

•শব্দার্থ:
ঝুইরা রয়= দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়,
ঝুইরা>ঝুরিয়া (সিলেটি প্রবাদ:
চোরের মনে কান্দেনা, মনে মনে ঝুরে। )
দুষ্কের জ্বালা= দু:খের জ্বালা,
নিধুয়া পাথার= ধুধু প্রান্তর ,
পাথার> প্রান্তর ।

এক ॥
প্রসঙ্গকথা:
কিছুদিন আগে কুড়াপাখি নিয়ে লিখেছিলাম । আজ হঠাৎ করে অন্য একজন ভ্রমণ বিষয়ক লেখকের একটি লেখা পড়ে অবাক হলাম। ঐ লেখায় কুড়া পাখির কথা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি চিল বা ঈগল পাখির ছবি দিয়েছেন। আরও অবাক হলাম, ঐ লেখক তাঁর লেখা ও ছবির সূত্র দিয়েছেন উইকিপিডিয়া (বাংলা) থেকে। কুড়া শিকারে অংশ নিয়ে এবং কুড়া পাখির ডাক শুনে শৈশব কেটেছে আমার। এখন এই আমাকে যদি কেউ ঈগল/চিল/বাজ/ পাখির ছবি দেখিয়ে বলেন: এই হলো কুড়া পাখি তাহলে সেটা কি মেনে নেয়া সম্ভব ? উইকিপিডিয়া ভিজিট করে আমি তো হতবাক ! সেখানে কুড়া পাখি হিসেবে চিল বা ঈগল পাখির ছবি এবং পরিচিতি দেয়া হয়েছে। কুড়া জলাভূমিতে বাস করে, অপরদিকে চিল সম্পুর্ণ বিপরীত।
এই যে চিল পাখিকে কুড়া পাখি বলে চালিয়ে দেয়া, এজন্য দায়ী কে ?
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ক’বছর আগে লন্ডনের একটি বাংলা টিভি চ্যানেল সেরাকন্ঠ প্রতিযোগীতার আয়োজন করে। সেই আয়োজনে বিলাতের বিভিন্ন শহরে প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্টিত হয়। সেখানে একজন প্রতিযোগী গাইলেন একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া। গানটি হলো ‘ ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের পানে চায়ারে’ । গানটির একটি লাইনে আছে ‘চিলমারীর বন্দরে’র কথা। এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। বৃহত্তর রংপুরের কুড়িগ্রাম জেলার একটি উপজেলা হলো এই চিলমারী। গানের লাইনটি হলো- ‘ওহকি গাড়ীয়াল ভাই, হাকাও গাড়ী তুঁই চিলমারীর বন্দরে রে’ । কিন্তু ঐ প্রতিযোগী গানটি গাইলেন এভাবে-
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই,কত
প্রকারের চিলমারিলে বন্দরে রে !’
বলা বাহুল্য, লন্ডনের নামকরা শিল্পীরা ঐ বাছাই পর্বে বিচারক হিসেবে ছিলেন। তাঁদের কাউকেই ঐ প্রতিযোগীর ‘চিল মারামারি’ ব্যাপারে কিছু বলতে দেখলাম না। আরও অবাক হলাম, প্রথমিক বাছাই পর্বে উক্ত প্রতিযোগী ‘ইয়েস’ কার্ড পেয়েছিলেন ! এ ধরনের ভুলকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি বলেই, চিলমারীর বন্দর বলার পরিবর্তে আনাড়ীরা চিল মারতে নেমে পড়েছে !

দুই ।। ভিন্নপাঠ, নাকি ভুলপাঠ: .

এটি একটি বিপুল জনপ্রিয় গান। জনপ্রিয় হওয়ার ফলেই গানটির বিকৃতিও ঘটেছে প্রচুর। আমাদের প্রবাদ আছে- আপনা মাংশে হরিনী বৈরী। অর্থাৎ সুস্বাদু মাংশ থাকায় হরিণের মাংশই তার বৈরী বা দুষমন। তেমনি জনপ্রিয় গান হলেই সবাই গাইতে চায়। ফলে কথার ভুল শুদ্ধ বিবেচনা ছাড়াই গাওয়া শুরু হয়, এক পর্যায়ে কথার বিকৃতি ঘটে। এ গানের কিছু বিকৃতির উদাহরণ তুলে ধরবো। এতে করে যারা গানটি গাইতে উৎসাহী তারা সতর্ক হতে পারবেন।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে- ভাওয়াইয়া গান উত্তরবঙ্গের উপভাষায় রচিত, তাই শব্দগুলো উচ্চারিত হবে ঐ অঞ্চলের লোকজন যেভাবে উচ্চারণ করেন, ঠিক সেভাবে । এর ভাষাকে পরিবর্তন বা শুদ্ধ করতে যাওয়া সমীচিন হবে না। যেখানে ‘চায়া’ (চায়+আ) বলা আছে সেখানে শুদ্ধ করতে গিয়ে ‘চাইয়া’ বললে চলবেনা। এ ভাওয়াইয়া গানটির যা কিছু বিকৃতি বা ভুল পাঠ আমার সামনে এসেছে তার একটি হলো ‘পন্থের পানে চায়ারে’ বলার পরিবর্তে ‘চাইয়ারে’ গাওয়া হয়। সঠিক হবে -‘চায়ারে’। পরের অন্তরায় ‘নারীর মন মোর ঝুইরা রয় রে’ এই লাইনে ‘ঝুইরা’ শব্দটিকে অনেকে অনেক রকম বলেন। ছুরিয়া, ধুড়িয়া ইত্যাদি বলা হয়। সঠিক শব্দটি হবে- ঝুইরা।
‘কি কব দুষ্কের জ্বালা’ কথাটাকে ‘কি কবো দুষ্টের জ্বালা (!)’ লেখা দেখলাম এক জায়গায়। হাসি আটকানো কঠিন হয় এমন ক্ষেত্রে । পরের অংশ হলো- ‘গাঁথিয়াচি কনমালারে’। আসলে, যেভাবে গাওয়া হয় সেভাবে লেখলাম এখানে। এ হলো উচ্চারণ ভঙ্গি, যা সুরের প্রয়োজনে কিছু আগে পিছে করতেই হয়। প্রকৃত কথাটা হলো ‘গাঁথিয়া চিকনমালা রে’। আমি প্রথম যখন গানটির অর্থ নিয়ে ভাবতে শুরু করি, তখন ‘গাঁথিয়াছি ক্ষনমালা’ মনে করে কী এই ক্ষনমালা বা এটা আবার কোন ধরনের মালা এ নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু ক্ষনমালা বা ঘনমালা কী এর জবাব পাইনি। শেষ পর্যন্ত বুঝলাম- সুরের প্রয়োজনে গাঁথিয়া শব্দের সাথে চিকনমালা শব্দের চি অংশটুকু জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে উচ্চারণ হয়- গাঁথিয়াচি…. কন মালারে। সে যাক রহস্যের সন্ধান পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । সবশেষ যে লাইন রয়েছে এ গানে তাহলো ‘কত কাঁদিম মুই নিধুয়া পাথারে রে’। এখানেও কেউ ‘নিথুয়া পাথরে রে,’ আবার ‘নিঠুরা পাথরে’ গাইতে বা লেখেতে দেখি, যা অনলাইনে দেখা বা শোনা যায়। কথাটা ‘নিধুয়া পাথারে রে’ হবে, অন কিছু নয়। খুব সম্ভবত রেকর্ড শোনে গান কপি করার ফলেই এ নানা রকম ভুলপাঠ সৃষ্টি হয়েছে।
অনলাইনে এই গানটির লেখক হিসেবে কেউ একজন শাহ আব্দুল করিমের নাম উল্লেখ করেছেন। এটি শাহ আব্দুল করিমের জন্মেরও শত বছর আগের একটি প্রচলিত গান । আজকাল যে কোন জনপ্রিয় লোকগানের গীতিকার জানা না থাকলে এক শ্রেণীর লোক শাহ আব্দুল করিমের নাম বসিয়ে দিচ্ছেন। এ দুষ্কর্ম বন্ধ হোক।

তিন॥ গানটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও পটভূমি:

এটি একটি ভাওয়াইয়া গান । বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বহুল জনপ্রিয় গান ভাওয়াইয়া । উত্তর বঙ্গ- বাংলাদেশের দিনাজপুর,রংপুর, পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়ি ও পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার এবং আসামের গোয়ালপাড়া-এ হলো ভাওয়াইয়া গানের প্রকৃত অঞ্চল। উত্তরবঙ্গে বড় নদী নেই। আছে ছোট ছোট নদী। তিস্তা, করতোয়া, আত্রাই, তোরষা, ক্ষিরোল, মনসাই, কালজানি, মহানন্দা প্রভৃতি নদী এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত। সেখানে পাহাড়ী ঢল নামে, নদীগুলো হয় খরস্রোতা। সেখানে চলেনা শান্ত সমাহিত ভাটিয়ালী । ফলেই সৃষ্টি হয়েছে-ভাওয়াইয়া । প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর জীবনের গান, ‘জৈবন’ এর সঙ্গীত। উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগে রয়েছে অসংখ্য জনবসতি, রয়েছে নিধুয়া পাথারের দিগন্ত প্রসারিত মাঠ-ঘাট। সেখানেই ছিল মহিষের বাথান, মহিষ বা গরুর গাড়ী। সেই মহিষ বা গরুর গাড়ী থেকে এসেছে ‘গাড়িয়াল বন্দু’ এবং ‘মৈষাল বন্দু’র গান। বাইরের শ্রোতাদের কাছে এক কথায় ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গানে অলৌকিকতার চেয়ে লৌকিকতাই দৃষ্ট হয় বেশী। নর-নারীর মনের ভাব বা পিরিত গানের কথায় আর দোতারার ঢাং এ সুরময় হয়ে ধরা দেয় ভাওয়াইয়া গানে। ‘মৈষাল বন্দু’র সাথে গ্রামীন পল্লীবালা কিশোরীর মনে যে ‘ভাব’ জমে ওঠে সেই ভাব ই এ গানে বাঙময় হয় ভাওয়াইয়া (ভাব+ইয়া) গান রুপে । মূলত করুণ বিরহ আশ্রিত ভাওয়াইয়া গান।
এ গানে ঐ সময়ের উত্তর বঙ্গের সাধারণ জনজীবন ও সংস্কৃতি চমৎকার ভাবে ধরা পড়েছে। বাড়ির দাওয়ায় বসে আছে একাকিনী নারী। পাশের রাস্তা দিয়ে মহিষের বা গরুর গাড়ী চালিয়ে গাড়ীয়াল চলছে গ্রামের হাটে অথবা উজানের সেই চিলমারীর বন্দরে। এ গাড়ীয়ালকে উদ্দেশ করে এ বিরহিনী কিশোরী বধূ তার মনের দু:খ বলছে। তার নিজেরও এক রসিক গাড়ীয়াল আছে, যে কিনা ঐ চিলমারীর বন্দরে গেছে ‘বণিজ’ করতে (‘বন্দুয়া মোর বণিজ গেইছে, উজানিয়ার দ্যাশে, সেইনা দ্যাশে পুরুষ বান্ধা, পড়ে নারীর কেশে)। সে ফিরে আসছেনা। তাই সে এই বাড়ীর পাশ দিয়ে চলে যেতে থাকা গাড়িয়ালকে প্রশ্ন করছে:
ওকি গাড়ীয়াল ভাই, কত রব আমি (তার) পন্থের পানে চায়া রে । এভাবে সে তার মনের ব্যথা বেদনা প্রকাশ করছে। এখানে আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘কি কব দু:খের জ্বালা’ হয়েছে ‘দুষ্কের জ্বালা’ । ‘চিকনমালা’ হলো সরু দৃষ্টি সুখকর মালা, যা সে গেঁথে সেই মন-মানুষের ফিরে আসার আশায় বসে অপেক্ষার প্রহর কাটাচ্ছে। গাড়ীয়াল ভাইয়ের/বন্ধু’র কাছে তার শেষ প্রশ্ন:
কত কাঁদিম মুই নিধুয়া পাথারে রে ? অর্থাৎ মালা গেঁথে অপেক্ষা আর কান্না আর কত ? তার এই কান্নার করুণ সুর ধুধু প্রান্তরে (নিধুয়া পাথার) ই নিত্য মিলিয়ে যায়। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এই যে কান্নার আওয়াজ হারিয়ে যাওয়া, এভাবে আর কত ??
আলোচ্য ‘ওকি ও গাড়ীয়াল ভাই’ এ গানটির কথা ও সুর প্রচলিত। এটি মরহুম আব্বাস উদ্দিনের গ্রামফোন রেকর্ডের যে মোট ৩৭ টি গান পাওয়া গেছে তার প্রথম দিকের রেকর্ডকৃত একটি গান। ১৯৩৭ খৃ: (আশি বছর আগে) এ গান গ্রামফোন রেকর্ড হয়।

-হাসনাত আনোয়ার
kakonfokir.com