প্রচ্ছদ

কবি লুৎফুন্নেছা লিলি : কিছু স্মৃতি কিছু কথা

  |  ১৫:২০, জানুয়ারি ২০, ২০২২
www.adarshabarta.com

 

নাজমুল ইসলাম মকবুল

 

কবি লুৎফুন্নেছা লিলি। দেখা ও পরিচয় হয় প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে ১৯৯১ এ। তখন লেখালেখি করতেন লুৎফা বেগম (লিলি) নামে। জাতীয় কবি সংগঠন অনুপ্রাস এর উদ্যোগে উপজেলা ভিত্তিক সাহিত্য প্রতিযোগিতায় স্বরচিত কবিতা ও প্রবন্ধের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীণ সিলেটের জেলা প্রশাসক ইসহাক ভূইয়া। জমজমাট অনুষ্ঠানটি ছিলো বিশ^নাথের রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।

এর বেশ কয়েকদিন পূর্বে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় কবি সংগঠন অনুপ্রাস এর উদ্যোগে উপজেলা ভিত্তিক সাহিত্য প্রতিযোগিতায় স্বরচিত কবিতা ও প্রবন্ধ আহবান করা হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য সাহস করে আমার সেসময়ের লেখা একটি কবিতা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেই পত্রিকায় উল্লেখিত ঠিকানায়। আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম সেসময়। কিন্তু আমার লেখা কবিতাটি যে প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনিত হবে তা কল্পনায়ও ছিলোনা।

কয়েকদিন পর দৈনিক সিলেটের ডাকসহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রেজাল্ট দেয়া হলো জাতীয় কবি সংগঠন অনুপ্রাস এর পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। পত্রিকায় দেখলাম আমি স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছি। ২য় হয়েছেন লুৎফা বেগম (লিলি) এবং ৩য় হয়েছেন শামমীমুল হক শিকদার। এর কয়েকদিন পর আমার কাছে একটি চিঠি আসলো। চিঠিতে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে পুরস্কার ও সার্টিফিকেট গ্রহণের দাওয়াতপত্রসহ স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জনের সুসংবাদ দেয়া হয়। এই খুশ-খবরিতে সেসময় আমার লেখালেখির গতি বেড়ে যায় আরও।

চিঠিতে উল্লেখিত নির্ধারিত তারিখে এক চমৎকার বিকেলে উপস্থিত হই বিশ^নাথের রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সিলেটের জেলা প্রশাসক ছাড়াও ঢাকা থেকে কবি জাহানারা আরজু, শেখ শামছুল হকসহ ঢাকা ও সিলেটের বেশ নামী দামী লেখক কবি সাহিত্যিকেরা অনুষ্ঠানে ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। মাঠে সামিয়ানা বাঁধানো বিশাল প্যান্ডেল। সাজানো চমৎকার উঁচু মঞ্চ। দলে দলে কবি সাহিত্যিকেরা আসলেন মঞ্চে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসকসহ ঢাকা ও সিলেট থেকে আগত অতিথিদের আগমণে মুখরিত অনুষ্ঠানস্থল।

উপস্থিতদের মধ্যে প্রায় সকলেই আধুনিক শিক্ষিত। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কেহ পড়ছেন আর কেহবা পড়াচ্ছেন। ব্যতিক্রম শুধু আমি। অনুষ্ঠানে পাঞ্চাবি টুপি পরিহিত একমাত্র মাদরাসা ছাত্র আমি। তাও আবার প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করতে আমন্ত্রিত হয়ে গেছি অনুষ্ঠানে। কিছুটা শরম শরমও লাগছে। কারন অনুষ্ঠানে আগত অন্যদের সাজসজ্জা পোসাক পরিচ্ছদ ও আমার সাজসজ্জা এক নয়। এরইমধ্যে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকেরা মঞ্চে উঠে আবৃত্তি শুরু করছেন কবিতা ও ছড়া। কয়েকটি নামের পর মাইকে নাম ঘোষনা হলো এখন কবিতা আবৃত্তি করবেন কবি লুৎফা বেগম (লিলি)। উল্লেখ্য সেসময় তিনি লুৎফা বেগম (লিলি) নামেই ছিলেন পরিচিত। পরবর্তীতে লুৎফুন্নেছা লিলি লিখতে শুরু করেন।

চমৎকার লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত কবি মঞ্চে উঠে গিয়ে দাড়ালেন ডায়াসে এক্কেবারে মাইকের সামনে। কবিতা আবৃত্তি করলেন চমৎকার এবং শুদ্ধ উচ্চারণে, চমৎকার ভঙ্গিমায়। মুগ্ধ হয়ে শুনলেন সবাই। দিলেন করতালি।

আমার চিনতে বাকী রইলোনা যে ইনিই আমার সাথে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পত্রিকায় উল্লেখিত সেই লিলি। অবশেষে জানতে পারলাম তিনি একজন শিক্ষিকাও। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। ভালো উপস্থাপিকা এবং আবৃত্তিকার।

মাঠভর্তি দর্শকদের উপস্থিতিতে জমজমাট আলোচনা সভা শেষে স্বরচিত কবিতায় প্রথম পুরস্কার ও সার্টিফিকেট গ্রহণের জন্য আমার নাম যখন উচ্চারণ করা হলো তখন আমি কিছুটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মঞ্চের দিকে যেতেই শুরু হলো তুমুল করতালি। অনেকে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন মাদরাসার ছাত্র (মুল্লাবেটা) কিভাবে কবিতা লেখে প্রথম পুরস্কার পায়। তাজ্জব ব্যাপারতো!

সেদিন কবি লুৎফা বেগম লিলিও আমার সাথে গ্রহণ করেছিলেন স্বরচিত কবিতা লেখায় পুরস্কার ও সার্টিফিকেট। এই পুরস্কার প্রাপ্তির খুশিতে আমার লেখালেখির গতি এতই বৃদ্ধি পায় যে আমি সেসময় প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিক কবিতা বা ছড়া লেখতাম। সেসময় আমার কবিতা-প্রবন্ধের আলাদা খাতাও ছিলো।

সেদিনের পর থেকে প্রায় ত্রিশ বছরের মতো অতিবাহিত হয়ে গেলেও কবি লুৎফুন্নেছা লিলির সাথে দেখা হয়নি আর। গত বছর সিলেটের আম্বরখানায় জসিম বুক হাউসে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে কবি লুৎফুন্নেছা লিলির সাথে দেখা হয়ে গেলো হঠাৎ করে কাকতালিয়ভাবে। অনুষ্ঠানে লেখক গবেষক আবু সালেহ আহমদসহ আমরা অনেকেই করেছিলাম অংশগ্রহণ। আমার বক্তব্যে সেই ত্রিশ বছর পূর্বের স্মৃতি করেছিলাম রোমন্থণ। কবি লুৎফুন্নেছা লিলিসহ সকলেই শুনেছিলেন তন্ময় হয়ে। ক্ষণিকের জন্য সকলেই চলে গিয়েছিলাম সেই ত্রিশ বছর পূর্বের স্মৃতিময় মুহুর্তে। কবি লুৎফুন্নেছা লিলি স্মৃতিচারণ শুনে হয়েছিলেন অভিভুত  আপ্লুত। দাওয়াত করেছিলেন একদিন বাসায় যাওয়ার। বলেছিলেন সেসময় আমি বিশ^নাথের একটি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। পরবর্তীতে চলে আসি সিলেট শহরে। শিক্ষকতা করি নগরির ব্লু-বার্ড স্কুলে। এখন অবসরে। আমার মেয়েরাও বড় হয়েছে। তাই এখন থেকে সাহিত্য সাধনা ও সাহিত্য সেবায় বাকী জীবনটুকু কাটিয়ে দিতে চাই। করতে চাই সমাজের সেবাও। কিন্তু কবির মনের আশা অনেকটা অপূর্ণই রয়ে গেলো। মহান আল্লাহ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হলো আপন ঠিকানায় হঠাৎ করে। আজ ১৯ জানুয়ারি ২০২২ সোসাল মিডিয়ায় কবি লুৎফুন্নেছা লিলির মৃত্যু সংবাদ শুনে সেই স্মৃতিগুলিই বার বার দোলা দিলো মনে।

দোয়া করি কবির নেক আমল সমুহ কবুল করে মহান রাব্বুল আলামীন তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে যেন একটু স্থান করে দেন। আ-মীন।।

 

……………………………

নাজমুল ইসলাম মকবুল

সভাপতি

সিলেট লেখক ফোরাম

০১৭১৮৫০৮১২২