প্রচ্ছদ

পাঁচ পুরুষের ঈদ : লাক্কড় দাদা থেকে নাতী

  |  ০৫:৩৩, মে ১৩, ২০২১
www.adarshabarta.com

 

নাজমুল ইসলাম মকবুল:

ঈদ মানে খুশি আনন্দ ফুর্তি। ইসলাম ধর্ম মুসলমানদের যে কটি দিবসকে আনন্দ ফুর্তি করার জন্য নির্ধারন করে দিয়েছে তার প্রধানতম দিবসটি হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। তাই এ দিনের আনন্দও ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। তবে এ আনন্দে অশ্লীলতার মিশ্রণ ঘটালে হিতে বিপরিতই হবে অর্থাৎ ছওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে। যেহেতু পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ইসলামী দিবস তাই ঈদুল ফিতর আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়ে আসছে সেই ইসলামের গোড়া পত্তন থেকেই। আমাদের সমাজে ঈদের দিনে হরেক রকমের আয়োজন থাকে। বিশেষ করে পবিত্র রমজানের শুরু থেকে আরম্ভ হয়ে যায় ঈদ উদযাপনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। তবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের ঈদের আচারানুষ্ঠান ও বর্তমান প্রজন্মের ঈদের আচারানুষ্ঠান তথা আনন্দ ফুর্তির মধ্যেও দেখা যায় বিস্তর ফারাক। আমরা পাঁচ পুরুষ তথা লাক্কড় দাদার আমল পর্যন্ত ঈদ উদযাপন ও ঈদের ফুর্তি ফার্তির অনুসন্ধানে দেখতে পাই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন চিত্র। সেই লাক্কড় দাদা থেকে পই দাদার আমল পই দাদা থেকে দাদার আমল এরপর বাপের আমল বাপ থেকে ছেলের আমল বা আমাদের আমল। আমাদের লাক্কড় দাদার আমল হিসেব করলে প্রায় একশ বছর পূর্বের আমল বা সময়কেই বলা যেতে পারে। তখন মানুষের জীবন যাত্রার মান ছিল খুবই সাদামাটা। মানুষ পদব্রজে হজ্জে যেতেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেও পায়ে হেটে কিংবা ঘোড়া বা গাধাকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে অভিজাত মহিলাদের ক্ষেত্রে সওয়ারী বা পালকী চড়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিনা ভিসায় যাতায়াত করার প্রচলন ছিল সে সময়। দুর গন্তব্যে রওয়ানা দিতে হলে দু-তিনমাস বা ছয়মাস হাতে রেখে রওয়ানা দিতে হতো। সে সময়ে তারা ঈদও উদযাপন করতেন নিতান্ত সাদামাটাভাবে। ঈদের জামাত আদায় এবং সাধ্যমতো কিছুটা বাড়তি খাবারের আয়োজনই ছিল বেশির ভাগ মানুষের ঈদ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর পই দাদার আমলেও মানুষের মধ্যে সম্পদের পাহাড় গড়ার কোন চিন্তা চেতনা বা স্বপ্ন ছিলনা বিধায় জীবন যাত্রার মান ছিল নিতান্ত সাদামাটা। তবে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল খুবই বেশি। বন্ধুন্ত বা ইয়ারানা ধর্মীয় খেশি বা কুটুমিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে সিংহভাগ মানুষের জীবন যাত্রার মান সে সময়ও উন্নত না হওয়ায় এবং জীবন যাত্রার মান উন্নত করার তাগিদ তাদের মধ্যে তেমন একটা অনুভুত না হওয়ায় সে সময়কার ঈদও তারা পালন করতেন সাদামাটাভাবে। তবে পাড়া পড়শী ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর দাদার আমল শুরু হলে সে সময় ঈদে সামর্থবান অনেকেই নতুন জামা কিনতেন। তবে সে সময় এতো ফ্যাশন ট্যাশনের প্রতিযোগিতা ছিলনা বিধায় পুরুষরা সাধারনত লুঙ্গী ধুতি গেঞ্জি আর মহিলাদের জন্য সুতি শাড়িই কেনা হতো। ঈদের জামাতের পূর্বে ঈদগাহ বা মসজিদে রোজাভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হতো। অভিনব এসব শাস্তির মধ্যে ছিল কান ধরে উঠবস করানো, কলাগাছ কাধে করে সারা ঈদগাহ মাঠ বা মসজিদের চতুর্দিক প্রদক্ষিন করা এমনকি আগত মুসল্লিদের জোতাও বহন করানো হতো ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা পরিত্যাগকারীদের। শাস্তি প্রদানের পর তওবা করানো হতো এবং ভবিষ্যতে আর রোজা না ভাঙ্গার মৌখিক অঙ্গীকার নেয়া হতো। বর্তমানে পিতার আমল থেকে শুরু করে ছেলের আমল চলছে। ঈদের আনন্দ ফুর্তিতেও এসেছে নতুনত্ব ও আধুনিকতার ছড়াছড়ি। পিতা বা দাদার আমলে সম্পূর্ণ দেশীয় যে পিঠা সন্দেশ তৈরী করা হতো তার আধুনিকায়ন হয়ে বর্তমানে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকার পাতা থেকে রেসিপি দেখে তৈরী করা হয় পিঠা পায়েস। আর এসব পিঠা বা সন্দেশের নাম পরিবর্তন হয়ে ধারন করে অত্যাধুনিক ও কঠিন কঠিন সব নাম। আগের যুগে বিক্ষিপ্ত বা উপরী কাপড়ের দোকান থেকে লুঙ্গী গেঞ্জি ও সুতি শাড়ি কেনার পরিবর্তে বর্তমানে গড়ে উঠা অত্যাধুনিক শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেট থেকে সদ্য আগত দেশি বিদেশি ডিজাইনের প্যান্ট সার্ট পাঞ্জাবী শেরওয়ানী ফতোয়া মোবাইল ড্রেস লেহেঙ্গা থ্রিপিছ শর্ট ড্রেস স্কাট বাহারী ডিজাইনের শাড়ি ইত্যাদি কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। বর্তমানে নায়ক নায়িকা বা মডেল তারকাদের পরিধেয় বস্ত্র অনুসরন করে নতুন নতুন ডিজাইন আমদানি করার প্রতিযোগিতাতো আছেই। অনেক অভিজাত পরিবারের লোকেরা পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যেতেও দেখা যায়। আত্মীয় স্বজনদের বাড়ী বেড়ানোর প্রবণতা কমিয়ে পার্ক অভিজাত হোটেল রেস্টুরেন্ট কপি বার পিকনিক বা বিনোদন স্পটে ভিড় করতে দেখা যায় বেশি। এছাড়া আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়ানোর পরিবর্তে অনেকেই ঘরে বসে বিভিন্ন চ্যানেলের ঈদ অনুষ্ঠান উপভোগেই বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকেন। আত্মীয় স্বজনদের বাড়ী বেড়ানোর বদলে রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতেই বেশি ভিড় করতে দেখা যায়। রাজনৈতিক নেতারাও নিজ নিজ বাড়িতে কর্মী সমর্থকদের জন্য গরু জবাই করে ভুড়িভোজের আয়োজন করার সংস্কৃতি গত ক’বছর থেকে বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। এছাড়া আগের দিনে ঈদ কার্ড ডাকযোগে প্রেরণের যে একটা সংস্কৃতি ছিল তা বর্তমান ডিজিটাল যুগে হ্রাস পেয়ে এস এম এস ও ইমেইলে এসে টেকেছে। ঈদের দিনে বিদেশে বসবাসরত আত্মীয়দের সাথে ফোনালাপ ও ইন্টরনেটের মাধ্যমে চেটিং বেড়েছে বর্তমান যুগে। পায়ে ধরে মা বাবাসহ গুরুজনকে সালাম করার প্রবণতা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। কেহবা পাহাড়সম অট্টালিকায় বসে এয়ারকুলারের বাতাসে গা ভাসিয়ে দিয়ে ডিসের মাধ্যমে বিনোদনে মত্ত আবার পাশের বাড়িতে তার আত্মীয় বা পড়শী নতুন জামা কেনা দুরের কথা জটর জ্বালায় দুমোটো ভাতও জোগাড় করতে পারছেনা, এ ধরনের দৃশ্য বর্তমান সমাজে চোখে পড়ার মতো। কিছু কিছু শিল্পপতি পত্র পত্রিকা বা মিডিয়ায় কভারেজ পাওয়ার জন্য জাকাতের কিছু নিম্নমানের মোটা সুতার কাপড় বিতরন করতে পত্রিকার পাতায় দেখা যায় এবং সাথে সাথে এও দেখা যায় যাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে কিংবা শিল্পপতির স্বেচ্ছাসেবকদের লাঠির আঘাতে নিহত বা আহত হওয়ার সংবাদ। বর্তমান যুগে ঈদকে সামনে রেখে বেড়ে যায় চাঁদাবাজি। অফিস আদালতের কর্তারা ঈদের দোহাই দিয়ে বাড়িয়ে দেন ঘুষের রেট আবার অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে বাড়িয়ে দেন পণ্যের মুল্য। বর্তমানে অনেকেই পাড়া বা মহল্লার মসজিদ বা ঈদগাহের পরিবর্তে জেলা সদরের বড় ঈদগাহ মাঠ বা বাংলাদেশের বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠে গিয়েও ঈদের জামাত পড়তে দেখা যায়। তবে এতে পড়শীদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করা সম্ভব হয়না। আবার কোথাও কোথাও কুলাকুলি করার প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে বিভিন্ন কারনে। বর্তমানে পত্র পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে কর্মী সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেও দেখা যায় রাজনৈতিক বা সামাজিক অনেক নেতা পাতিনেতাকে। তবে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে ঈদকে উপলক্ষ করে নেতাদের কর্মতৎপরতা ব্যাপকহারে বাড়তে দেখা যায়। তখন শুরু হয় ভোটারদের মোবাইল নাম্বার অনুসন্ধানের হিড়িক। অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করা হয় ভোটারদের নামে এস এম এস পাটাতে। তবে নির্বাচনের পরে বেমালুম ভুলে যান ভোটারদের কথা। তখন বেড়ে যায় চাটুকারদের কদর। এছাড়াও হাল জমানার ঈদ ও আগের জমানার ঈদে আরও বিস্তর ব্যবধান রয়েছে যা আমাদের প্রবীণ মুরব্বীয়ানদের সাথে আলাপ করলে জানা যায়।

 

লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম

০১৭১৮৫০৮১২২