প্রচ্ছদ

যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় ক্ষত-বিক্ষত

  |  ০৭:৩৫, ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual8 Ad Code

বাংলাদেশী কমিউনিটি, মৃত্যু ৩ শতাধিক

মোঃ নাসির, নিউ জার্সি (আমেরিকা) প্রতিনিধি:

Manual1 Ad Code

যুক্তরাষ্ট্র ক্ষত-বিক্ষত করোনায়। এই অতিমারিতে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী অভিবাসী জনগোষ্টী।কোভিডের প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত বিপর্যস্ত করে ফেলেছে গোটা কমিউনিটিকে।বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে এখন হানা দিয়েছে এই মরণ ব্যাধি। করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশী অধ্যুষিত রাজ্য নিউইয়র্ক ও মিশিগানে।মিশিগানে কোভিড এর চিত্র কতোটা ভয়াবহ তা উঠে এসেছে দুটি মসজিদ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে। তাদের দেয়া তথ্যে প্রতিদিন অবিরত চলছে মৃতদের যানাজা ও দাফন কাপনের কাজ।আতংকিত হয়ে পড়েছে গোটা কমিউনিটি।

পেন্ডামিক শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছেন কোভিডে। অনেক পরিবার হারিয়েছেন একাধিক সদস্য।কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা, কেউ বা আপন সন্তানের অকাল বেদনাময় মৃত্যুতে শোকে পাথর। আবার কেউ একমাত্র উপার্জনকারী হারিয়ে দিশাহারা। মৃতের তালিকায় আছেন মুক্তিযোদ্ধা, ডাক্তার ইন্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যাবসায়ী, রাজনীতিবিদ। সমাজসেবীসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষ।

কমিউনিটির অনেকেই করোনায় মৃত্যু লোকলজ্জার কারণে গোপন রাখতে চান। ফলে মৃত্যু বা আক্রান্তের সঠিক তথ্য-পরিসংখ্যান পাওয়া প্রায় অসম্ভব।কমিউনিটি এক্টিভিষ্টরা মৃত্যুর এই সংখ্যা আরো অনেক বেশী হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন।যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত ২শ ৮৫ জন বাংলাদেশীর মৃত্যুর তথ্য জনসমক্ষে এসেছে।এই পরিসংখ্যান কমিউনিটির বিভিন্ন সুত্র থেকে পাওয়া।

নিউইয়র্কে কোভিডের অবস্থা এখন ভয়ানক উল্লেখ করে সিনিয়র সাংবাদিক, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ও টাইম টেলিভিশনের সিইও আবু তাহের মানবজমিনকে বলেন, পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক।প্রায় ঘরেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।শীতের তীব্রতা ভাইরাসকে করছে আরো শক্তিশালী।এক কথায় মানুষজন দিশেহারা।

Manual8 Ad Code

করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু হলেও থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল।প্রথম ধাপে ভ্যাকসিন পাচ্ছেন ডাক্তার নার্স সহ যারা ফ্রন্ট লাইনে কাজ করছেন কেবল তারা।সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হতে কয়েক মাস সময় লাগবে।তারপরও ভ্যাকসিন নিলেই কোভিড থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে সেটাও পরিস্কার নয়। কেবল চলতি মাসের গত ২৮ দিনে ৪৫ জন অবিভাসীর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে ঘাতক করোনা।এই মৃত্যু নিউইয়র্কে বেশী।এরপর রয়েছে মিশিগান নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়া। প্রায় ২ শ বাংলাদেশী করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্ক মিশিগানসহ বিভিন্ন রাজ্যের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

মিশিগানে নিজ বাসায় মারা যান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও আশির দশকে সিলেটের মোস্তফা আল্লামা গোল্ডকাপ খ্যাত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা আল্লামা (৭৭)।স্হানীয় পুলিশ তার বাসার দরোজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে।মৃত্যু পর পরীক্ষায় তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে।মোস্তফা একাই বসবাস করতেন। তার বাড়ী সিলেটের গোলাপগঞ্জে। গত ২৩শে ডিসেম্বর মিশিগানে করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর এবাদুর রহমান (৭৪)।তার বাড়ী মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্ণি গ্রামে। এবাদুর রহমানের পুরো পরিবার করোনা আক্রান্তহয়ে পড়েন।তার স্ত্রী ও ২ ছেলে বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি নিজে প্রায় ৩ সপ্তাহ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে যান।তিনি হ্যামট্রামিক শহরের বাংলাদেশ এ্যভিনুস্হ বায়তুল মামুর মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

প্রায় ১ মাস হাসপাতালে থেকে করোনার কাছে পরাজয় বরণ করে নেন মিশিগান ষ্টেটস বিএনপির সাবেক আহবায়ক শামীম আখতার খাঁন (৬২)।

তার দেশের বাড়ী সিলেট শহরতলির দক্ষিন সুরমার পাঠান পাড়া গ্রামে। এনামুল হক (৫৫)।তার গ্রামের বাড়ী সিলেটের বিয়ানীবাজা উপজেলার মাথিউরায়। এনামুল হক ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রিয় মেম্বার ছিলেন।

Manual2 Ad Code

করোনা ছিনিয়ে নিয়েছে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের নর্থ শোর এলএইজের প্যাথোলজিক্যাল বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তৌফিকুল ইসলামকে (৬১)।তিনি নিউইয়র্ক বাংলাদেশী কমিউনিটির অত্যন্ত প্রিয় মুখ ছিলেন।তিনি ২ সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থানয় থেকে গত ১৩ই ডিসেম্বর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।বাংলাদেশী চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন।ডা. তৌফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সাবেক সভাপতি।তার স্ত্রী ডা. নাঈমা ভূঁইয়া একজন খ্যাতনামা ডেন্টিস্ট।

গত ২১শে ডিসেম্বর নিউইয়র্কের কোনি আইল্যান্ডের বাসিন্দা ইমিগ্রেশন আ্যটর্নী সাঈদ আলী হায়দার (৪২ ) করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান।তিনি ঢাকার বাসিন্দা। হায়দার যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সুহেলের শ্যালক।

ওয়াশিংটন মেট্রো আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ খসরু করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন ৯ই ডিসেম্বর। তিনি ভার্জিনিয়ায় মারা যান। তার ছোট ভাই লেখক সাংবাদিক ইশতিয়াক রুপু।খসরুর দেশের বাড়ী সুনামগঞ্জে।

গত ১৯শে ডিসেম্বর মাত্র ৩ ঘন্টার ব্যবধানে করোনায় নিউইয়র্কে মারা যান পিতাপুত্র। ব্রুকলিনের বাসিন্দা ইন্জিনিয়ার মোহাম্মদ খাইরুজ্জামান (৬৭) ও তার একমাত্র ছেলে আবুল বাশার পান্না সিপিএ (৪৫)। তাদের দেশের বাড়ী সন্দীপে। বাবা ও ছেলের করুণ মৃত্যুতে নিউইয়র্কে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

১৩ই ডিসেম্বর করোনা কেড়ে নেয় নিউইয়র্কের বোর্ড অব এডুকেশনের ক্যারিকুলামে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথিকৃত কুইন্স কলেজের খন্ডকালীন ও লং আইল্যান্ড সিটি হাই স্কুলের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ (৭১) মারা যান ৩০শে নভেম্বর।দীর্ঘ ২১ দিন মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে লড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটসের বাসিন্দা গোলাম রহমান সেলিম (৪৮)। ভাগ্নির বিয়েতে ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এলমহার্স্টের শেফালী বেগম (৫৫)।

ব্রন্কসের বাংলাদেশী মোহাম্মদ জাফরের মৃত্যুতে বাংলাদেশীদের সঙ্গে কেঁদেছে আমেরিকার মানুষও।সিএনএন জাফরকে নিয়ে মর্মস্পর্শী একটি প্রতিবেদন প্রচার করলে কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।আমেরিকা যাদের রক্ত ঘামে রঙিন ও মহান হয়ে উঠেছে জাফর ছিলেন তাদের একজন।নিজে অসম্ভব পরিশ্রম করে ছেলেকে পাঠিয়ে ছিলেন বিখ্যাত হার্ভাডে।পেশায় ইয়েলো ক্যাবি জাফর নিউইয়র্কের রাস্তায় ট্যাক্সি চালাতেন। মেয়েকে পড়াতেন সেরা ট্রিনিটি স্কুলে।তার জীবনের গল্প থামিয়ে দিয়েছে করোনা।জাফরের দেশের বাড়ী সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া।

পেনসেলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটে সিলেটের অতি প্রিয়মুখ জুলকারনাইন জায়গীরদারের। তিনি প্রায় ৩ সপ্তাহ

হাসপাতালে থেকেও আপনজনদের সান্নিধ্যে ফিরে আসতে পারেননি।সিলেটের হাউজিং ষ্টেটসের বাসিন্দা জুলকারনাইন ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ সংগঠক ও বিশিষ্ট সমাজকর্মী।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান মিশিগান কমিউনিটির অন্যতম একজন মুরব্বী কামরুজ্জামান (কমই মিয়া)। তিনি দীর্ঘ দিন যাবত স্বপরিবারে মিশিগান রাজ্যের ওয়ারেন শহরে বসবাস করে আসছিলেন। এছাড়া করোনা ছিনিয়ে নেয় মিশিগান কমিউনিটির সুপরিচিত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ হোসেনের পিতা সানাওর আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশিষ্ট সংগঠক সিরাজম মুনির, দুদু মিয়া, মদরিছ আলী, বড়লেখা সমিতির উপদেষ্টা চুনু মিয়ার মা নেওয়ারুন নেসা ও পিতা মনির উদ্দীন,আনোয়ার হোসেনের মা, বিয়ানী বাজার সমিতির সভাপতি নুরুজ্জামান এখলাসের শ্বাশুড়ী সামসুন নেহার, লুৎফুর রহমান, আব্দুল আহাদ লোদী ও সুফিয়া খাতুন। মারা গেছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন মন্তাজ খাঁন।অত্যন্ত ধর্ম পরায়ন মন্তাজ খাঁন ছিলেন ডেট্রয়েট শহরের মসজিদুন নুরের দীর্ঘকালীন মুয়াজ্জিন। এদের সকলের দেশের বাড়ী বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্হানে।

ডেট্রয়েট শহরের অন্যতম মসজিদ আল ফালাহর খতিব ও বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আব্দুল লতিফ আজম মানবজমিনকে জনান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মসজিদের ফিউনারেল হোমে কোভিড-১৯-এ মৃতদের লাশ আসছে প্রতিনিয়ত। তারা প্রায় প্রতিদিন জানাযা পড়াচ্ছেন। করছেন দাফন কাফনের ব্যাবস্থা।

মিশিগান কমিউনিটির সবথেকে পুরনো মসজিদ মসজিদুর নুরেও প্রায় প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হচ্ছে মৃতদের নামাজে জানাজা।মসজিদ কমিটির সদস্য কমিউনিটি নেতা ইকবাল হোসেন চৌধুরী এ তথ্য জানিয়ে বলেন, কেবল ডিসেম্বর মাসেই প্রায় ৩০ জন আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মিশিগানে।

Manual2 Ad Code

করোনা অতিমারিতে নাকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন গড়ে প্রতি ৩৩ সেকেন্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন একজন। মোট আক্রান্ত প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ।এ পর্যন্ত মৃত্যু প্রায় ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার।

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code