প্রচ্ছদ

ধর্ষণ প্রতিরোধে মৃত্যুদণ্ড: অ্যান্টিবায়োটিকটি শক্ত হলেও কাজ হবে কি?

  |  ১৬:৪০, অক্টোবর ১৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ::

মনে রাখতে হবে যে, মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর বিধান থাকার পরও বহু দেশ জঘন্য ধরনের অপরাধসমূহ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আবার মৃত্যুদণ্ডের বিধানই নেই এ রকম বহু দেশ রয়েছে, যেখানে অপরাধ সংঘটনের হার একেবারেই অপ্রতুল। যেমন নেদারল্যান্ডস এ রকম একটি দেশ, যেখানে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই, অথচ দেশটি কারাগারে পুরে রাখার মতো কোনো অপরাধী খুঁজে পায় না।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই বাংলাদেশে ধর্ষণ কী করে মহামারি হয়ে ওঠে? যে দেশের মানুষের মানসপট গঠিত কবিগুরু-নজরুল-লালন-জীবনানন্দ-বেগম রোকেয়া-সুফিয়া কামাল ও জহির রায়হানের গান-কবিতা-গল্প ও ভাবাদর্শ দিয়ে; যে দেশের মানুষ তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মণি সিংহ ও জাহানারা ইমামের রাজনৈতিক চেতনা ও আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন; সে দেশে গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা কীভাবে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়? যে দেশে পীর ও আউলিয়ারা ধর্ম প্রচার করেছেন; যে দেশের মানুষের চেতনায় আছে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা; যে দেশের মানুষ ধর্মনিষ্ঠ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়; সেই দেশে কী করে হুড়মুড় করে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়?

শুধু আদর্শ ও নীতিনিষ্ঠ মানুষই নয়, যেকোনো সুস্থ-স্বাভাবিক ও সংবেদনশীল মানুষের কাছে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইলে তারা নির্বাক হয়ে থাকবেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বর্ণনাতীতভাবে ভয়াবহ! এক দশক আগেও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নারীরা পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতেন। কিন্তু পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, পুরুষ সদস্যরা সঙ্গে থাকার পরও নারীরা হত্যার শিকার হচ্ছেন, বর্বর পুরুষেরা নারীদের ছিনিয়ে নিয়ে গণধর্ষণে লিপ্ত হচ্ছে।

গত ২০ সেপ্টেম্বর নীলা নামের ১৪ বছরের এক কিশোরী যখন তার ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাচ্ছিল, তখন মিজান (২০) নামের এক দুর্বৃত্ত ওই রিকশার গতি রোধ করে দাঁড়ায়। এরপর অস্ত্রের মুখে নীলাকে টেনেহিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে একটি গলির ভেতরে নিয়ে নীলার গলায়, পেটে ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করে তাকে হত্যা করে। দিন কয়েক পরেই এক নারী তার স্বামীর সঙ্গে সিলেটের এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে গেলে একটি ছাত্রসংগঠনের দুর্বৃত্তরা তার স্বামীকে বেঁধে রেখে তাকে গণধর্ষণ করে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না-কাটতেই নোয়াখালী থেকে খবর আসে যে, দেলোয়ার নামের এক সন্ত্রাসী এক নারীকে বিবস্ত্র করে অত্যাচার করেছে। প্রতিনিয়ত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের নির্মম ঘটনাগুলো আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ করছে এবং দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফিরছে।

সিলেটের খাদিজাকে মাটিতে ফেলে বদরুল নির্মমভাবে কুপিয়েছিল। সোহাগী জাহান তনুকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে শারীরিক মর্যাদা নষ্ট করার পর হত্যা করা হয়েছিল। নুসরাতকে চারদিকে থেকে চেপে ধরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে উচিতশিক্ষা দেয়া হয়েছিল। মজনু রাতের নির্জনে একলা নারীকে পেয়ে তার রিরংসা চরিতার্থ করে ফেলে গিয়েছিল খিলক্ষেতের কাছের নির্জন এলাকায়। তালিকা আরো দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু কী লাভ? প্রতিদিন ঘটনা ঘটছে। কোনো কিশোরী দিনের পর দিন বখাটে কর্তৃক উত্ত্যক্ত হওয়ার পর প্রতিকার না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। শত শত নারী শিকার হচ্ছে পুরুষের ধর্ষকাম ও লালসার। ৩ থেকে ৮-৯ বছরের কন্যাশিশুও রেহাই পাচ্ছে না। তিন মাসে ৩–৯ বছরের কন্যাশিশু ধর্ষিত হয়েছে দুই শর অধিক। ‘মডারেট’ মুসলমানদের দেশ এখন পরিণত হয়েছে গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার অভয়ারণ্যে!

কত আর বলা যায়? কত আর লেখা যায়? ঘটনাগুলোর কোনো লাগাম নেই, কোনো প্রতিকার নেই। ধর্ষণ মামলায় কনভিকশন রেট থ্রি পার্সেন্ট! কী ভয়াবহ তথ্য! ১০০ জন ধর্ষকের মধ্যে শাস্তি পাচ্ছে মাত্র ৩ জন। বখাটে ও ধর্ষকদের শাস্তি দেয়া না গেলে আইন-আদালত, ও পুলিশ রেখে লাভ কী? সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা গতকাল (১২ অক্টোবর) ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’-এর ৯ (১) ধারা সংশোধনের খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। সংসদ অধিবেশন না থাকায় আজ এটি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হয়েছে।

আইনের একজন অধ্যাপক ও অপরাধবিজ্ঞানের একজন গবেষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের সমাধান হিসেবে ‘মৃত্যুদণ্ড’ নামক যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, সেটি সুচিন্তিত নয় এবং এতে সুফল মিলবে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, ধর্ষণের মাধ্যমে হত্যার ঘটনায় ১৯৯৫ সালে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি ধর্ষণ ও ধর্ষণের মাধ্যমে হত্যাকে বন্ধ করতে বা কমাতে পারেনি। ওই আইনটি টিকেছিল মাত্র পাঁচ বছর।

আমি মনে করি, সমাজ ও বিচারিক প্রক্রিয়ার সর্বত্র নানা অসংগতি রেখে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়ে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। যে দল এবং সরকার ২০০৮ সালে পরিকল্পিতভাবে রূপকল্প–২০২১ প্রণয়ন করেছিল, যারা বাংলাদেশের উন্নয়নে ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান করেছে, সেই সরকারের কাছ থেকে আমি ধর্ষণ ও গণধর্ষণ সমস্যার ‘অ্যাডহক’ সমাধান আশা করি না। তাড়াহুড়ো করে মৃত্যুদণ্ডের মতো ‘অ্যান্টিবায়োটিকে’র ব্যবস্থা না করে সরকারের উচিত ছিল সমাজবিজ্ঞানী, পুলিশ কর্মকর্তা, অপরাধবিজ্ঞানী, আইনজীবী, সাংবাদিক, আমলা, আইনের অধ্যাপক, জনপ্রতিনিধি ও বিচারপতিদের নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা। কমিটির টার্মস অব রেফারেন্স হওয়া উচিত ছিল- ধর্ষণের মহামারি হয়ে ওঠার কারণ নির্ণয় ও এটি সমাধানে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা।

মনে রাখতে হবে যে, মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর বিধান থাকার পরও বহু দেশ জঘন্য ধরনের অপরাধসমূহ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আবার মৃত্যুদণ্ডের বিধানই নেই এ রকম বহু দেশ রয়েছে, যেখানে অপরাধ সংঘটনের হার একেবারেই অপ্রতুল। যেমন নেদারল্যান্ডস এ রকম একটি দেশ, যেখানে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই, অথচ দেশটি কারাগারে পুরে রাখার মতো কোনো অপরাধী খুঁজে পায় না। সুইডেন, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, কিন্তু সেখানে অপরাধ, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, প্রতারণা– এসব অপরাধ খুবই কম। এর মূল কারণ হচ্ছে, সুশাসন, সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন।

সরকারের কাছে আরো একটি পথ খোলা ছিল এবং খোলা আছে; আর সেটি হচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা। হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিজ্ঞ বিচারক- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৯ সালে ধর্ষণ মামলাগুলোর যথাযথ নিষ্পত্তি না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন। ২০১৬ সালে মিলাদ হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার না হওয়া এবং সে কারণে কোনো জবাবদিহি না থাকায় গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা প্রকাশ করেন।

২০১৯ সালে রাহেল ওরফে রায়হান বনাম রাষ্ট্র মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা বলেন, দেশের বিভিন্ন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিপুলসংখ্যক ধর্ষণ মামলা বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ, যার মধ্যে ৪-৫ বছরের পুরোনো মামলার সংখ্যাও অনেক। এসব মামলায় বিচারপতিগণ কর্তৃক চিহ্নিত ত্রুটিসমূহ হচ্ছে– (১) পুলিশি তদন্তে গাফিলতি; (২) মামলার অভিযোগ গঠনে বিলম্ব; (৩) ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী উপস্থিত না হওয়া; (৪) বিরামহীনভাবে শুনানি না করা; (৫) ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দুই থেকে পাঁচ মাস পরপর তারিখ নির্ধারণ ইত্যাদি।

এটা খুবই লক্ষণীয় যে, হাইকোর্ট কিন্তু বলেননি যে মৃত্যুদণ্ড না থাকাই ধর্ষণ বাড়ার কারণ; বরং বলেছেন, দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করাই ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ। হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারপতিগণ সুনির্দিষ্ট দুটি কমিটি গঠনের কথা বলেছেন- একটি ছিল সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দায়িত্ব এবং অন্যটি জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সরকার যদি ১৮০ দিনে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ করতে ব্যর্থ বিচারক, পুলিশ ও প্রসিকিউটরদের যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যার আইনি বিধান বাস্তবায়ন করতে পারত এবং সংশ্লিষ্টরা ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে বিচারক, পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারি উকিলদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারত, তা হলেও কিছু সুফল পাওয়া যেত।

(লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরাধ বিশ্লেষক।)