প্রচ্ছদ

শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক মরহুম আপ্তাব আলী স্যার 

  |  ১৪:৫৩, মে ০৯, ২০২২
www.adarshabarta.com
তাজ উদ্দিন আহমদ:
আজ ৮ই মে ২০২২ অলংকারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মানুষ গড়ার সুমহান কারিগর শিক্ষাবিদ আপ্তাব আলী স্যারের ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী। জনাব আপ্তাব আলী সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী বিশ্বনাথ উপজেলাধীন ৩নং অলংকারী ইউনিয়নের বড়তলা গ্রামে ১৯৪৯ সালের ১লা জানুয়ারী জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মরহুম হোসেন আলী এবং মাতার নাম মরহুমা নফিজা বানু। তিনি ২০০৬ সালের ৮ ই মে দিবাগত রাতে তাঁর নিজ বাড়িতে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে অসময়ে মৃত্যুবরণ করেন( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন —–)। জনাব আপ্তাব আলী ছহিফাগঞ্জ এম এফ প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন । তিনি ১৯৬৫ সালে রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতঃ কৃতিত্বের সাথে (এস এস সি) পাশ করে সিলেটের মদন মোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাশ করেন এবং ১৯৭৮ সালে সরকারি টিচার্স্ ট্রেনিং কলেজ, কোটবাড়ি, কুমিল্লা থেকে প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্স বি.এড সম্পন্ন করেন।
জনাব আপ্তাব আলী ১৯৬৭ সালে কাইয়া কাইড় ধিতপুর এম.এফ প্রাইমারী স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৭১ সালে কচরাকেলী এম এফ প্রাইমারী স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হন এবং ১৯৭২ সালে নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী বড় খুরমা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে বড় খুরমা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বদলি হয়ে অলংকারী পৌদনাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১লা জানুয়ারী ২০০৬ সালে চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ অলঙ্কিত করেছিলেন। চাকুরির মধ্যবর্তি সময়ে ১৯৮৩ সাল হতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বিনা বেতনে ছুটি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে প্রবাস জীবন অতিবাহিত করেন এবং ১৯৮৪ সনে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন।
জনাব আপ্তাব আলী শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষকদের ন্যায্যদাবী আদায়ের লক্ষ্যে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তিনি গ্রাজুয়েট প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বিশ্বনাথ শাখার সভাপতি, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বিশ্বনাথ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক, অলংকারী ইউনিয়ন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে থাকা অবস্থায় অত্যন্ত দক্ষতার সহিত তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জনাব আপ্তাব আলী মদন মোহন কলেজে পড়ার সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করেন। তিনি ১৯৭২-৭৩ সালে ৩ নং অলংকারী ইউনিয়ন ট্রাইবুন্যাল কোর্ট এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এলাকায় শিক্ষা ও সাংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। স্থানীয় বড়তলা দাখিল মাদ্রাসা, জমির আহমদ হাই স্কুল,সফাত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়সহ এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ও তাঁর বিচরণ ছিল নিয়মিত। বিশ্বনাথ কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি সহ বিশ্বনাথ পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য ছিলেন। স্যারের লেখা গান, ছড়া,কবিতা,গল্প, প্রবন্ধ নানা সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক গাঢ় হয় যখন স্যার উনার একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ডালিম কে ১৯৯৩ সালে ঐতিহ্যবাহী এম সি কলেজ এ একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি করেছিলেন। আমি জানিনা স্যার কীভাবে জানতে পেরেছিলেন আমি ঐ কলেজে অধ্যয়নরত এবং আমি দ্বিতীয় ছাত্রাবাসের একজন আবাসিক ছাত্র। স্যার উনার ছেলেকে নিয়ে আমার রুমে আসলেন এবং উনার ছেলেকে যেকোন অবস্থায় আমাদের দ্বিতীয় ছাত্রাবাসে একটি সিটের ব্যবস্থা করার জন্য বললেন। সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল এবং তার এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল ভাল হওয়ার কারনে হোস্টেলের যে কোন ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র হওয়ার তার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্যারের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্বিতীয় ছাত্রাবাসে ভর্তি করেন এবং যেকোন অবস্থায় আমার রুমে তার থাকার ব্যবস্থা করার জন্য আমাকে পরামর্শ দেন। তখনকার প্রেক্ষাপটে শত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও ছাত্রাবাসের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্যার আমার উপর আস্থা রেখেছিলেন, জানিনা স্যারের সে আস্থার প্রতিদান আমি কতোটুকু দিতে পেরেছিলাম। স্যার প্রতি বৃহস্পতিবারে স্যারের ক্লাস শেষ করে ডালিম কে দেখার জন্য হোস্টেলে যেতেন, এবং আমাদের খাবার জন্য কোন কিছু নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। সন্ধ্যাবধি তিনি হোস্টেলে অবস্থান করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেন। রোদ বৃষ্টি সর্বাবস্থায় স্যারের সাথে একটি হ্যান্ড ব্যাগ ও একটি ছাতা থাকত। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাদামনের একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ ছিলেন। এলাকার সকল মানুষের কাছে তিনি একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কারও সাথে তাঁর কোনও বিভেদ ছিল না। স্যারের ছেলে এখন একজন বি সি এস ক্যাডার ও বিশেষজ্ঞ (এফ সি পি এস) ডাক্তার। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ।
অত্যন্ত সৎ ও নির্লোভ জনাব আপ্তাব আলী স্যার শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অর্জিত সীমিত আয় দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ সন্তানদের বরন-পোষন ও পড়ালেখার ব্যায়বার মিটিয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, ছেলেমেয়েদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে, রেখে গেছেন একটি আলোকিত পরিবার। স্যারের প্রত্যেক ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে এখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষকতার সুবাদে দেশে বিদেশে অবস্থানরত স্যারের অগণিত ছাত্রছাত্রীও আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত এসব ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্যারের গর্বের শেষ ছিল না। এলাকার ছাত্রছাত্রী কিংবা তাদের অভিভাবকদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি সবসময় প্রতিষ্ঠিত ছাত্রদের সম্পর্কে আলোচনা করতেন। বিভিন্ন সভা- সমাবেশে স্যার তাঁদের উদাহরণ দিতেন। আজ ৮ই মে ২০২২ স্যারের ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী। আজকের এই দিনে স্যারের ১৬তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমি পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের কাছে তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। হে গাফফার এই সজ্জন, নিরহংকার, আপাদমস্তক ভালো মানুষটিকে মাফ করে দিন। হে মহান আল্লাহ, রাহমানুর রাহিম এই কর্মবীর, সৎ নির্লোভ মানুষটিকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন, ইয়া রাব্বাল আ’লামিন।
বি দ্র:- তথ্য দানে সহযোগিতা করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই কবি নাজমুল ইসলাম মকবুল কে।
তাজ উদ্দিন আহমদ
ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড হেড অফ ব্রাঞ্চ, প্রাইম ব্যাংক লি:, আম্বরখানা শাখা, সিলেট।