প্রচ্ছদ

যেভাবে শুরু পহেলা বৈশাখ-বাংলা নববর্ষ

  |  ১২:১২, এপ্রিল ১৪, ২০২২
www.adarshabarta.com

অধ্যাপক ড.মীজানুর রহমান :

পহেলা বৈশাখ-বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতিসত্তা, চেতনা ও অনুভবে প্রবলভাবে বিরাজ করছে। আমাদের চিরায়ত জীবনের এক হৃদয়স্পর্শী দিনের শুরু হয় এই বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে। পহেলা বৈশাখ আমরা পালন করি সর্বজনীন এক বর্ষবরণ উৎসব। এই দিন উৎসবের আমেজে ভাসে পুরো দেশ। এই উৎসব যেন আমাদের আপন জাতিসত্তার বা আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের। আমাদের জীবন আচরণের প্রতিকৃতিই হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ যেভাবে এসেছে তা বিভিন্ন বই থেকে জানা যায় যে-হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক আগে থেকেই ছিল। এই সৌর পঞ্জিকা শুরু হয় গ্রেগরীয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। এই হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ আসাম, বঙ্গ, কেরালা, মণিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়– ও ত্রিপুরার সংস্কৃতির অংশবিশেষ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালন করা হতো। বর্তমান সময়ের মত তখনকার সময় পহেলা বৈশাখ পালিত হত না। তখনকার সময়ে পহেলা বৈশাখ পালিত হত ঋতুধর্মী উৎসব বা আর্তব উৎসব হিসেবে-যার মূল তাৎপর্য ছিল কৃষি। ইতিহাস থেকে জানা যায় কৃষি থেকেই পহেলা বৈশাখের উৎপত্তি। ভারতবর্ষে মোঘলরা তাদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর (বাংলা যুক্ত হয় ১৫৭৬ সালে) মোঘল স¤্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। হিজরী সন নির্ভর করত চাঁদের উপর। হিজরী সন অনুযায়ী কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতে গিয়ে তা মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা দিতে হত। সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য খাজনা আদায় আরো সহজ করার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর প্রাচীন বর্ষপুঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। মোঘল সম্রাট আকবরের আদেশে বাংলার বিখ্যাত জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সৌরবর্ষ ও আরবী হিজরী সনের ভিত্তিতে নতুন বাংলা পঞ্জিকা তৈরি করেন। বাংলা সনের পঞ্জিকা তৈরি করেন ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ মতান্তরে ১১ মার্চ থেকে। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল থেকে অর্থাৎ ০৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ (হিজরী ৯৬৩ সন) থেকে এই বাংলা সনের কার্যকারিতা শুরু করা হয়।
আবার কোন কোন গবেষকদের মতে, জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খানের নেতৃত্বে ১৬০৮ সালে বাংলা সন গণনা শুরু হয়েছিল। হিজরী সালের সঙ্গে ফসল তোলার সময় প্রতি বছর ১১ দিন করে সরে যায়, সেজন্য হিজরী সালের সংখ্যা ঠিক রেখে কিন্তু মাসগুলো শকাব্দ থেকে নিয়ে (অর্তাৎ সৌরমাস পরিবর্তন করে) আবুল ফজল প্রবর্তন করেছিলেন ‘ফসলি সাল’ এবং তা কেবল সুবে বাংলার জন্য নয়, গোটা আকবর সম্রাজ্যের জন্যই। যদিও এতে হিসেবের একটা গরমিল থেকেই যায়। এজন্য উত্তর ভারতের কোন কোন প্রদেশে এ সাল পহেলা বৈশাখে শুরু না হয়ে, শুরু হয় চান্দ্র আশ্বিনের পহেলা থেকে।যাই হোক এ কথা সত্য, স¤্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। প্রথম দিকে এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’। পরে এর নাম হয় ‘বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ’। তখন প্রত্যেক কৃষককেই বাংলা বর্ষের বা বাংলা সনের হিসেবে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের আগেই তাদের সব খাজনা, শুল্ক ও মাশুল পরিশোধ করতে হত। চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা আদায় হলে চৈত্রের শেষ দিনের পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভুমির মালিকরা তাদের অঞ্চলের মানুষদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতে শুরু করেন। এ আপ্যায়ন উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। যার রূপ পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের এই পর্যায়ে এসেছে। তৎকালীন সময়ে পহেলা বৈশাখের অন্যতম ঘটনা ছিল হালখাতা করা। হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিন থেকে নতুন বছরের জন্য পুরানো হিসাব বই বন্ধ করে নতুন একটি হিসাব বই খোলা। পহেলা বৈশাখের হালখাতার দিনে দোকানিরা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করান। এই হালখাতার প্রথাটি আজো প্রচলিত।
তবে আধুনিক নববর্ষ উদ্যাপনের খবর পাওয়া যায় প্রথম ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশরা বিজয় অর্জন করলে, সে বিজয় কামনা করে ১৯১৭ সালের পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও হত এই আয়োজন। ১৯৪৭ সালে আমাদের এই উপ মহাদেশে দেশ ভাগের পর পাকিস্তানী আমলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ পালনের বিষয়টি সু-নজরে দেখেননি। ষাটের দশকের শেষদিকে আইয়ুব খানের শাসনামলে বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমন শুরু হয়েছিল। আর তখন থেকেই ঘটা করে আমাদের এ অংশে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। ঢাকায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’। সংগঠনটি পহেলা বৈশাখে নতুন সূর্য ওঠার সাথে সাথে গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে আহবান জানায়। আর যে স্থানটি থেকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানায়, সে স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে তা অশ্বত্থ গাছ। যাটের দশকে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ- নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৭ সাল থেকে ‘রমনার বটমূলে’ ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। (এই নিবন্ধে উপরের দিকে হিসেবের গড়মিলের একটু উল্লেখ করা আছে) এক্ষেত্রে বাংলা সন সৌর সন হলেও খ্রিস্টীয় সৌর সনের সঙ্গে দিন-তারিখের পার্থক্য বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন-১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে বাংলা সন সংস্কারের জন্য প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে তার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যরা আলোচনা-পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বৈশাখ থেকে ভাদ্র প্রতি মাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে প্রতি মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে। তবে অধিবর্ষে চৈত্র মাস ৩০ দিনের স্থলে ৩১ দিন হবে। এতে খ্রিস্টীয় সালের সাথে বাংলা সনের আর কোন হের ফের হবে না। সেই থেকে আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে এই বর্ষপুঞ্জি পালন করা হয়। অতঃপর ১৯৬৭ সাল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিলেই রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের সকালে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান-যা এখনও বর্ষবরণের প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়। কালেক্রমে ঢাকার বৈশাখী উৎসবের সাথে যুক্ত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যে শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবন ফুটে তোলা হয়। শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা হয় রং-বেরংয়ের বিভিন্ন রকমের মুখোশ আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। অমাদের ্ঐতিহ্যের এ উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেস্কোয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে। লেখক: ড.মীজানুর রহমান, অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।