প্রচ্ছদ

বিশ্বনাথের গর্ব শিক্ষাবিদ আব্দুল মান্নান

  |  ০২:২৫, নভেম্বর ২৭, ২০২১
www.adarshabarta.com
তাজ উদ্দিন আহমদ
আজ ২৭ শে নভেম্বর ২০২১ ইং আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আব্দুল মান্নান স্যারের ৮ম মৃত্যু বার্ষিকী। মরহুম জনাব আব্দুল মান্নান বিশ্বনাথ পৌরসভার আওতাধীন ঐতিহ্যবাহী রাজনগর গ্রামে ১৪ই এপ্রিল ১৯৫২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মুজেফর আলী সারেং। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। জনাব এম এ মান্নান বিশ্বনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন শেষে স্থানীয় রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৬ সালে উক্ত বিদ্যালয় হতে এস এস সি, তৎকালীন সিলেট এম সি কলেজ থেকে আই এ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সিলেট সরকারী কলেজ থেকে বি এ সম্মান ( অর্থনীতি) ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তিতে ১৯৭৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে এম এ পাশ করেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি স্থানীয় রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষি বিদ্যাপীঠ রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ের অত্যন্ত দাপুটে শিক্ষক ছিলেন মরহুম জনাব আব্দুল মান্নান। উচ্চ শিক্ষিত, ন্যায়পরায়ন, দুর্দান্ত সাহসী, প্রগতিশীল স্থানীয় এই শিক্ষক অত্যন্ত সফলতার সহিত এই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। তাঁর সময়ে এধরনের একজন উচ্চ শিক্ষিত লোক চেষ্টা করলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা না করে অন্য কোন লোভনীয় পেশায় ও আত্মনিয়োগ করতে পারতেন। কিন্তু আব্দুল মান্নান স্যার সেপথে না হেঁটে নিজ এলাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা, ধনে-জনে খ্যাত প্রবাসী অধ্যুষিত আমাদের এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকলেও কর্মজীবনে তিনি সামাজিক কার্যক্রমে বেশি সময় ব্যয় করেছেন। বিদেশ বিমুখ জনাব আব্দুল মান্নান ১৯৮৩ সালে পারিবারিক সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্য প্রবাসী মিস্ সুরাইয়া ইয়াসমিন এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পরও তিনি অন্য পেশায় না গিয়ে আবারও সেই শিক্ষকতা কেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এই শিক্ষাবিদ। যুক্তরাজ্যে জনাব এম এ মান্নান শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন বিশ্বনাথ এর শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সেখানে অবস্থানরত বিশ্বনাথ উপজেলার বিভিন্ন বয়সী শিক্ষানুরাগি, সমাজসেবী, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ স্যারের প্রাণপ্রিয় সাবেক ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে ১৯৯৪ সালের ১২ই জুন গড়ে তোলেন ” বিশ্বনাথ প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্ট”। তিনি এই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সহ একাধিক বার সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি এই প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্ট বিশ্বনাথের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের গরীব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপক ভাবে উপকৃত হয়েছে। স্যারের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যার এই ট্রাস্টের সাথে অঙ্গা-অঙ্গি ভাবে জড়িত ছিলেন এবং অত্যন্ত সুচারুরূপে দক্ষতার সহিত ট্রাস্ট টি পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে ট্রাস্টের সদস্য সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্যারের অনেক সাবেক ছাত্র ট্রাস্ট টি পরিচালনায় এগিয়ে এসেছেন। (আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ চিত্তে আমাদের প্রবাসী ভাইদের/অভিভাবকদের ট্রাস্টের মাধ্যমে রাখা অবদানের কথা স্বীকার করছি)।
অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন প্রাজ্ঞ, সফল, আদর্শ শিক্ষক ছিলেন মরহুম জনাব আব্দুল মান্নান। সবসময় ছাত্রদের উপর স্যারের প্রবল আস্থা ছিল। যা বিভিন্ন সময় স্যারের কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিয়মান হতো। আমরা রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে একটি বিষয় সব সময় লক্ষ্য করতাম, বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশেষ করে সিনিয়র ভাইয়েরা বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী থানার পুলিশ,বাসের শ্রমিক, উশৃংখল ব্যবসায়ী বা বখাটে ছেলেদের সাথে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে লিপ্ত হতেন। পরবর্তিতে ঘটনার গুরুত্ব অনুসারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি কিংবা স্টাফ কাউন্সিলে যখন শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, তখন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব স্যার সব সময় নিজ কাধে তুলে নিতেন। স্যার এসে বেত হাতে নিতেন এবং ষোল আনা শাস্তি কার্যকর করে ছেড়ে দিতেন। স্যার কোন দ্বিধাদন্দ্বে ভোগতেন না। ছাত্রদের উপর স্যারের এত বেশি নিয়ন্ত্রণ ছিল, এত কিছুর পরও কোনও ছাত্র কোনও ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না বা দেখানোর সাহস পেতেন না। এটিই ছিল স্যারের শিক্ষকতা জীবনের বড় স্বার্থকথা। আমরা ছাত্রাবস্থায় একটি কথা সব সময় জেনে এসেছি,” শাসন করা তাঁরই সাজে সোহাগ করে যে”। আমার মনে হয় স্যারের বেলা এ উক্তিটি ছিল শতভাগ প্রযোজ্য।
সর্বশেষ আগষ্ট ২০১৩ সালে আমি যখন যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম তখন জানলাম স্যার মরণব্যধি ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। আমাদের রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘৮৪ ব্যাচের বন্ধু জাহেদ বক্ত চৌধুরীকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে স্যারকে দেখতে গেলাম। স্যার অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাদেরকে হাসপাতালে দেখে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। হাসপাতালের ভেতর কথা বলতে পারবেন না বিধায় আমাদের সাথে এই ভগ্ন শরীর নিয়ে হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসলেন এবং কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাথে অনেক কথা বললেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম স্যারের কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। আমরা স্যারকে বিছানায় যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করছিলাম কিন্তু স্যার যেতে চাইছিলেন না। অবশেষে স্যার বিদায় নিয়ে খুব বিমর্ষ হয়ে চলে যাওয়ার সময় বারবার আমাদের ফিরে ফিরে দেখছিলেন। আমরাও মনের অজান্তে চোখের জল মুছতে মুছতে কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে এসে বসলাম এবং সোজা বাসায় চলে আসলাম। এটিই ছিল স্যারের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা। এরপর আর স্যার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেননি। আমি দেশে আসার পর ২০১৩ সালের ২৭ শে নভেম্বর আমাদের প্রবাসী বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পেলাম স্যার মরণব্যধি ক্যান্সার এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহিরাজিউন—)। স্যার আজ আমাদের মধ্যে নেই সত্যি কিন্তু স্যারের কৃতকর্মের জন্য দেশেবিদেশে অবস্থানরত স্যারের অগণিত ছাত্রছাত্রী স্যারকে স্মরণ করছে বিনম্র শ্রদ্ধায়। আজকের এ দিনে আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করি। হে মহান আল্লাহ, এই সজ্জন, কর্মবীর ও ভাল মানুষকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন, ইয়া রাব্বুল আ’লামিন।
তাজ উদ্দিন আহমদ
ব্যবস্থাপক, প্রাইম ব্যাংক বিয়ানী বাজার শাখা, সিলেট।