প্রচ্ছদ

সুসাহিত্যিক আপ্তাব আলী স্যার : একজন আদর্শ শিক্ষক গর্বিত পিতা

  |  ০৫:৪৪, নভেম্বর ২০, ২০২১
www.adarshabarta.com

 

নাজমুল ইসলাম মকবুল

 

কচি খোকা ছিলাম যখন

পাঠশালাতে যেতাম

স্যারের নিকট অনেক অনেক

আদর সোহাগ পেতাম।

পাঠ শেখাতেন ক্লাসের মধ্যেই

স্যার যে অনেক কষ্ট করে

সেই প্রতিদান কেমনে দেবো

ভাবলে শুধুই অশ্রু ঝরে!

স্যারের কাছে ঋনী আছি

অনেক ঋনী সারা জীবন

এ ঋন শোধের নেই ক্ষমতা

মুটোয় দিলেও নিখিল ভুবন।

আজো আছেন এই আঙ্গিনায়

জীবন নামের শেষ বেলাতে

হয়তো জীবন বিলিয়ে দিবেন

মানুষ গড়ার কারখানাতে।

কবিতাটি লেখার পর দৈনিক সিলেটের ডাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। স্যার দেখে হয়েছিলেন আনন্দে অভিভূত। স্যার আমাকে বলেছিলেন আমাকে সিলেটের ডাক এর একটি কপি দিয়, আমি সংরক্ষণ করে রাখব। সদা প্রাণচাঞ্চল্য হাসিখুশি মুখ অমায়িক ব্যবহার চালচলনে নিরহংকারী জনাব আপ্তাব আলী স্যার আজীবন মানুষ গড়ার কারখানায় কাটিয়ে দিয়ে যখন একটু জিরিয়ে নেবার জন্য চাকুরি থেকে অবসর নিলেন তখন আর সময় পেলেননা এ পৃথিবীর আলো বাতাসে আর কয়টা দিন বেচে থাকার। মহান আল্ল¬াহ পাক রাব্বুল আলামীন তাকে যেন পাঠিয়েছিলেন কর্মের মধ্যে বেচে থাকতে অবসরে নয়। তাই চিরতরে অবসর নিয়ে অগণিত শিষ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয় স্বজন রেখে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে পাড়ি দিতে হলো বিগত ৮ই মে ২০০৬ইং সোমবার দিবাগত রাত ১১.৪০ মিঃ এর সময় পরপারে।

জন্ম: জনাব আপ্তাব আলী স্যার সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী বিশ্বনাথের ৩নং অলংকারী ইউনিয়নের বড়তলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ১ জানুয়ারী ১৯৪৯ইং সনে। পিতার নাম মরহুম হোসেন আলী,  মাতার নাম মরহুমা নফিজা বানু।

শিক্ষা: ছহিফাগঞ্জ এম. এফ. প্রাইমারী স্কুল থেকে পাঠশালা শেষে বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৫ সনে কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি পাশ করে সিলেটের মদন মোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৭ সনে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৭০ সনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাশ করেন এবং ১৯৭৮ সনে কোটবাড়ি কুমিল¬াস্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহা বিদ্যালয় থেকে বি. এড সমাপন করেন।

চাকুির: শিক্ষাজীবন সমাপন করে ১৯৬৭ সালে কাইয়া কাইড় ধিতপুর এম.এফ প্রাইমারী স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৭১ এ কচরাকেলী এম. এফ. প্রাইমারী স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হয়ে বদলী হন এবং ১৯৭২ এ নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী বড় খুরমা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৭৬ এ অলংকারী পৌদনাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ০১.০১.২০০৬ ইং চাকুরি থেকে অবসর নেন। চাকুরির মধ্যবর্তি সময়ে ১৯৮৩ সাল হতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বিনা বেতনে ছুটি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে প্রবাস জীবন অতিবাহিত করেন এবং ১৯৮৪ সনে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন।

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির যে সব পদে দায়িত্ব পালন: ১৯৭২-১৯৮৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, বিশ্বনাথ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭২-১৯৮১ পর্যন্ত ৩নং অলংকারী ইউনিয়ন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্র সম্পাদক, ১৯৮৬-২০০৫ পর্যন্ত অলংকারী ইউনিয়ন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ইউনিয়ন সভাপতি এবং ১৯৮৭-১৯৯০ পর্যন্ত গ্রাজুয়েট প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, বিশ্বনাথ শাখার সভাপতির দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন।

সামাজিক উন্নয়নে অবদান: সামাজিক উন্নয়নেও জনাব আপ্তাব আলী স্যার যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন জমির আহমদ হাই স্কুল, বড়তলা দাখিল মাদরাসা এবং সফাত উল্ল¬াহ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭২-৭৩ সালে ছিলেন ৩নং অলংকারী ইউনিয়ন ট্রাইবুন্যাল কোর্ট এর চেয়ারম্যান। ১৯৯০-৯২ পর্যন্ত ছিলেন বিশ্বনাথ কেন্দ্রীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং বিশ্বনাথ পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য। এছাড়া এলাকার রাস্ত ঘাট ব্রিজ কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণেও রেখেছেন প্রশংসনীয় অবদান।

সাহিত্য চর্চা: বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা, ছড়া ও গান লিখে লেখার মধ্যেই অমর হয়ে আছেন জনাব আপ্তাব আলী স্যার।

পারিবারিক বিবরণ: মহান স্বাধীনতার বৎসর ১৯৭১ সালে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার কুরুয়া গ্রামের আলহাজ্ব আব্দুছ ছুবহান সাহেবের কন্যা রোকেয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ডাঃ মোঃ মঈনুল ইসলাম ডালিম যিনি এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস (অ্যানেসথেসিয়া), সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অ্যানেসথেসিয়া ও আইসিইউ বিভাগ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ এ কর্মরত আছেন। কন্যা হোছনো আরা বেগম, মনোয়ারা বেগম, উম্মে রওশন তিনজনই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে মানুষ গড়ার মহান দায়িত্বে কর্মরত আছেন। সর্বকনিষ্ট মেয়ে উম্মে আসমা বি এ অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

স্মৃতির এ্যালবাম থেকে: স্যারের ব্যক্তিগত গুণাবলীর ছিটেফোটা আলোকপাত করতে হলে আমার কিশোর বয়সের পাঠশালা জীবনের দেখা সেই অতীতের স্মৃতির এ্যালবাম খুলে দেখতে হয়। আমরা যখন কৈশোরে অলংকারী পৌদনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম তখনকার সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন শ্রী নির্মল চন্দ্র দাস, জনাব আপ্তাব আলী স্যার, শ্রী সুভাষ চন্দ্র ভৌমিক (যিনি বর্তমানে সিলেট জর্জ কোর্টে আইন পেশায় নিয়েজিত)। আরও কিছু শিক্ষক আসা যাওয়া করেছিলেন যারা কিছুদিন পর পর বদলী হয়ে অন্যত্রও চলে গিয়েছিলেন। পৌদনাপুর নিবাসী শ্রী নির্মল চন্দ্র দাস ছিলেন প্রখর মেধাসম্পন্ন বয়সে প্রবীণ এবং হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। এককথায় ছাপার হরফের মতো। আমাদের পিতা এবং তাদের বড়োরাও এই স্কুলে তাঁর কাছে পড়েছেন বলে জানা যায়। এলাকার অধিকাংশ ভূমির দলিলও তিনি লিখতেন সেসময়ে। ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক সবাই তাকে ডাকতেন মাস্টর বাবু বলে। মাস্টর বাবুর কাচা চিকন বাশের কঞ্চির আঘাতের ভয়ে এলাকার অনেকেই স্কুলে না গিয়ে বাড়ী থেকে বই পুস্তক নিয়ে বের হয়ে পালিয়ে গাছের ডালে কেহবা খড়ের ঘরে কিংবা বিভিন্ন গোপন স্থানে আশ্রয় নিতেন বলেও জনশ্রুতি আছে। তাঁর ভয়ে অনেকের লেখাপড়াও গোল¬ায় গেছে চিরতরে।

বেত্রাঘাতে অনেকেরই জ্বর হতো। কারো প্রস্রাব ও রক্ত প্রবাহিত হতো আবার ঝাঝালো চড়ের আঘাতে কেহবা বধির হয়েছেন বলেও জানা যায়। মুখের দাত কটমট (কিড়িমিড়ি) দেখলে ভয়ে গলার ভেতরের পানি শুকিয়ে যেন কাট হয়ে যেতো।

কাঁচা বাশের কঞ্চি দিয়ে সজোরে দুনু হাতের তালু ও সারা শরিরে শপাং শপাং পিটুনি ছাড়াও মাস্টর বাবু বেশ অভিনব পন্থায় শাস্তি দিতেন ছাত্রছাত্রীদেরকে। যেমন পুরো বেঞ্চের বা  ক্লাসের ছাত্ররা পড়া না শিখলে বা অংক করতে না পারলে বেঞ্চের সাইডে বসা ছেলের গালে কয়েক মন ওজনের চড় কষে দিতেন। ছাত্রটি টাল সামলাতে না পেরে পাশে উপবিষ্ট ছাত্রের মাথায় ঠাস করে খেতো টক্কর। এভাবে বেঞ্চে বসা প্রত্যেকের মাথায় প্রচন্ড শব্দে টক্কর খেতে খেতে দেয়ালের পাশে বসা ছাত্রটি পাকা দেয়ালের সাথে খেতো টক্কর। শব্দ হতো নারিকেল ফাটানোর শব্দের মতো। অভিনব পদ্ধতিতে এক চড়েই বেঞ্চে বসা পাচ ছয়জনকেই শাস্তি দিতেন, যেন এক ঢিলে পাচ ছয় পাখি শিকার করা। মাথা ফুলে সুপারির মতো হলেও ভয়ে কেহ কিছু বলতোনা। অভিভাবকদের মধ্য হতে অধিকাংশেরই শিক্ষাগুরু ছিলেন বিধায় তারাও টু-শব্দ করার সাহস পেতেননা। ছাত্র ছাত্রীরা স্কুলে পৌছেই প্রথমে খেয়াল করতো মাস্টর বাবু এসেছেন কি না। না আসলে সকলেই মহাখুশি। সবাই মাস্টর বাবু আসার রাস্তা অর্থাৎ পৌদনাপুরের রাস্তার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে দেখতো তিনি আসছেন কি না এবং দোয়া করতে থাকতো আজকে যেন মাস্টর বাবু স্কুলে না আসেন, কেহবা হয়তো মান্নত টান্নতও করতো। একদিন পার হলে মনে হতো যেন একটি বছর পার হয়েছে। সময় পার হয়ে গেলে মহাখুশি হতো সকলেই। কিন্তু যেদিন দেখা যেত মাস্টর বাবু সফেদ ধুতি পরে স্কুলের দিকে হন হন করে এগিয়ে আসছেন সেদিন সকল ছাত্র ছাত্রীর মন বিষাদে ও আতংকে ভরে উঠত। সকলেরই মনে দেখা দিতো এক অজানা আতংক। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে চেহারা ছবিতে ধারন করতো কালো বর্ণের রেখা। স্কুলে আসার আনন্দ পরিণত হতো মাটিতে।

পরবর্তীতে আরও কিছু শিক্ষক আসা যাওয়া করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন হেডস্যার ছিলেন গায়েগতরে বড়োসড়ো এবং সফেদ চেহারার। তিনি মানসিকভাবে ছিলেন একটু অন্যরকম। দেখা যেতো আনমনা আনমনা ভাব নিয়েই আছেন সবসময়। শ্রেণীকক্ষে চেয়ারে বসে বেশিরভাগ সময় কাঠাতেন ঘুমিয়ে। শিক্ষার্থীদের পড়ানোর তেমন একটা খেয়ালই দেখা যেতোনা ওই স্যারের। বিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ছাত্রীরা একটি উপাধিও দিয়েছিলো তাকে।

অপরদিকে খুবই হালকা পাতলা গড়নের এবং ফর্সা লম্বা আরেক স্যার ছিলেন সম্পূর্ণ বিরিত স্বভাবের। ক্লাসে এসে বলতেন আমাকে কে কে ভালো পায় বলো। শিক্ষার্থীদের পাঠদান না করে প্রায় প্রতিদিনই ক্লাসে ঢুকেই বলতেন সবাই ইংগারসিটি (এবিসিডি) লেখো। সবাই তা লেখে টেবিলে খাতা জমা দেবার পর সকল খাতা না দেখেই দ্রুত ঠিক চিহ্ন দিয়ে সময় পাস করে চলে যেতেন। এভাবেই চলতো তাঁর পাঠদান কার্যক্রম। লেখাপড়া না করানোয় ছাত্রছাত্রীরা হৈ হুল্লুড় করলে বাশের কঞ্চি দিয়ে সকলের মাথায় একটা একটা করে বাড়ি দিতেন। এই ছিলো তার কাজ। তাকেও কিছু ছাত্রছাত্রীরা দিয়েছিলো একটি উপাধি। এই উপাধিনামেই ডাকতো সবাই তাকে, তাঁর অগোচরে।

কিন্তু ওই দুজনের পূর্বেকার সময়ের প্রধান শিক্ষক আপ্তাব আলী স্যার ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ছাত্রদেরকে মাথায় কিংবা পিটে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহ করতেন আপন সন্তানের মতো, কোন সময় বন্ধুর মতো, আবার কোন কোন সময় সহপাঠির মতো। শ্রেণীকক্ষেই মুখে মুখে শিখিয়ে দিতেন পড়া। সকল ছাত্রকেই আদর করে টেনে নিতেন বুকে। প্রয়োজনমতো শাসন করতেন তবে বাড়াবাড়ি করতেন না।

স্যার শিক্ষার্থীদেরকে শাসনের পরিবর্তে আদর করতেন বেশি। কারন আদর না করলে ছাত্র ছাত্রীরা তাদের শিক্ষককে যমের মতো ভয় করবে এবং স্কুল থেকে পালাবে। কোন কোন শিক্ষককে ছাত্র ছাত্রীরা আজরাইলের মতো ভয় করে তাদের কঠোর শাসন বেত্রাঘাত বা অভিনব শাস্তি প্রদানের দরুন। তবে বিভিন্ন কারনে বর্তমানে এ প্রবণতা  হ্রাস পাওয়া, অভিভাবকদের সচেতনতা ও সরকারের বিভিন্ন প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়ায় বিদ্যালয়গামী ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শুরুতেই স্কুল থেকে পালালে যে কোন ছাত্র ছাত্রী ভবিষ্যতে লেখাপড়া করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনাই বেশি। স্যারের মধুরতম পরশে সকল ছাত্র ছাত্রীরাই স্যারকে খুবই শ্রদ্ধা করতো। এবং স্যার ক্লাসে আসলেই সকলের মুখেই ফুটে উঠত হাসির রেখা।

স্যার আমাকে স্নেহ করতেন মন প্রাণ উজাড় করে। পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষনার সময় আমি প্রথম স্থান অধিকার করায় স্যার খুবই আনন্দিত হয়ে ক্লাসে এসে আমাকে সুসংবাদটি দিয়েছিলেন আবেগঘন ভাষায়। যে স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। পাঠশালা শেষে হাই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়ার পর করণীয় সম্পর্কেও স্যার মুল্যবান উপদেশ দিতেন। পাঠশালা শেষে কারা কারা লেখাপড়া করছে এবং কারা ছেড়ে দিয়েছে তারও খোজখবর নিতেন এবং অভিভাবকরদের সাথেও যোগাযোগ রাখতেন নিয়মিত। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন লেখাপড়ার খবরাখবর। উপদেশ দিতেন মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করার এবং মানুষের মতো মানুষ হবার। আমি ছাত্রাবস্থায়ই কবিতা ছড়াসহ কিছু লেখালেখি করতাম। যেহেতু স্যারেরও কবিতা ছড়া গল্প প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখার অভ্যাস ছিল তাই স্যার লেখালেখিতেও উৎসাহ প্রদান করতেন আমাকে। বলতেন বেশি বেশি করে লেখালেখি করো, দেখবে এভাবে একদিন অনেক বড়ো লেখক হয়ে যাবে। স্যারের এসব কথাবার্তা আমার জীবনে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

স্যারের জীবদ্দশায় শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার কারন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উত্তরে বলেন ‘‘শিক্ষকতা এক মহান পেশা। ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের শিক্ষাদান করা নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। বিশ্বের যতসব দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন তারা শিশুদেরকে শিক্ষাদান করার বিভিন্ন পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন, শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে। এই মহান ব্রত নিয়েই আমি শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলাম।’’

এ মহান পেশায় দায়িত্ব পালন করে নিজেকে কতটুকু সুখী ভাবেন এ প্রশ্নের উত্তরে স্যার বলেন ‘‘শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি সন্তানদেরকে আল্লাহপাকের অনুগ্রহে লেখাপড়া করাতে সক্ষম হয়েছি। চাকুরী শেষে পেনশন প্রাপ্ত হয়ে বাসগৃহ নির্মাণে কিছুটা সহায়ক হয়েছে বলে নিজেকে আপাতত সুখী মনে করছি’’।

আদর্শ ছাত্র হতে হলে কি কি গুণাগুণ থাকা দরকার এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন ‘‘নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত থাকা, মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করা, সু-স্বাস্থ্যের জন্য সুসম খাবার খাওয়া, নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যয়াম করা, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলা, স্কুলের সহ পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করা, সহপাঠীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, রুটিন মোতাবেক স্কুলে ও বাড়ীতে লেখাপড়া করা, একমাত্র শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ব্যতীত রেডিও ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ না করা, দুষ্ট ছেলেদের সাথে স্কুল ছাড়া অন্যত্র খেলাধুলা না করা, পিতা মাতার অবাধ্য না হওয়া ইত্যাদি’’।

জনাব আপ্তাব আলী স্যার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ সন্তানদেরকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে গেছেন, রেখে গেছেন একটি আলোকিত পরিবার। আমাদের মতো অগণিত ছাত্রদেরকেও রেখে গেছেন যাদের অনেকেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। যাদেরকে দেখলেই স্যারের মুখে ফুটে উঠত হাসির রেখা এবং টেনে নিতেন একেবারে কাছে থেকে আরও কাছে। আমরা সব সময়ই মহান আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীনের কাছে স্যারের রুহের মাগফিরাত ও জান্নাতুল ফিরদাউস কামনা করি।

…………………………………………..

নাজমুল ইসলাম মকবুল
সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম
০১৭১৮৫০৮১২২

nazmulsylhet@gmail.com