প্রচ্ছদ

মরমি কবি ইবরাহীম তশ্না, পর্ব-১

  |  ১৩:৩৮, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২১
www.adarshabarta.com

:: নন্দলাল শর্মা ::
বাংলাদেশের মরমি সাহিত্যে সিলেটের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে সকল মহান মরমি কবি এই পুণ্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করে জাতিকে আলোকিত করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন ইবরাহীম আলী তশ্না ফারুকী (রহ.)। তাঁর জন্ম ১৯৭২ সালে সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার বাটইআইল গ্রামে। তাঁর পিতা-কাদেরীয়া তরিকার প্রখ্যাত পীর হজরত মাওলানা শাহ আবদুর রহমান কাদ্রী। তাঁদের পূর্বপুরুষ শাহ তকীউদ্দিন (রহ.) ছিলেন পবিত্র ভূমি মক্কা নগরী থেকে আগত হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর অন্যতম সফরসঙ্গী।
গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে ইবরাহীম আলী প্রখ্যাত ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ছাত্র হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় আরবি ও ফারসি শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। সেখান থেকে হাদিসশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে তিনি বাংলাভাষী মুসলামানদের গৌরব বৃদ্ধি করে দিল্লিতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ নয় বছর পড়াশোনা করেন।
গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে ইবরাহীম আলী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার দিল্লি যান। শায়খুল হাদিস হজরত মাওলানা নাজির হুছাইন মদনির কাছে তিনি দু’বছর হাদিস অধ্যয়ন করেন। তাঁর জ্ঞানপিপাসা দেখে ওস্তাদ মদনি সাহেব তাঁকে ‘তশ্না’ অর্থাৎ ‘পিপাসু’ উপাধি দ্বারা সম্মানিত করেন। তখন থেকে তিনি ইবরাহীম তশ্না নামে পরিচিত হন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
সাধারণ মানুষের মধ্যে কুরআন-হাদিস প্রচারের উদ্দেশে ইবরাহীম তশ্না ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চলে ইসলামী জলসার প্রবর্তন করেন। তিনি খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক কারনে তাঁকে কারাবাসও করতে হয়। ১৯২২ সালে ২৩ মার্চ কানাইঘাট মাদ্রাসার জলসা উপলক্ষে বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন ইবরাহী তশ্না। পুলিশ সভাস্থলে গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলে কয়েক জন শহিদ হন এবং অনেকেই কারাবরণ করেন।
তাঁর কারামতের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন লেখকের বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে। শেষজীবনে তিনি খোদার প্রেমে বিভোর হয়ে উদাসী বেশে দিন যাপন করতেন। এজন্য তিনি উদাসী তশ্না নামে খ্যাত হন। আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ভাবতেন, কখনো হাসতেন, কখনো কাঁদতেন, আবার কখনো বা মাঠেঘাটে ঘোরাঘুরি করতেন। এ অবস্থায় তিনি মরমি গান রচনা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর গানের সংকলন ‘নূরের ঝংকার’ প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র কয়েকটি গান নিয়ে। এছাড়া তিনি উর্দু ও ফারসিতে দু’শতাধিক শের রচনা করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। (চলবে)
লেখক: নন্দলাল শর্মা, অধ্যাপক ও গবেষক
তথ্যপঞ্জি
আশরাফ সিদ্দিকী: লোক সাহিত্য হয় খ-, ঢাকা ১৯৯৫
গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক সম্পাদিত : শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত, কলিকাতা ১৯৬৬
নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত : বাঁশির সুরে অঙ্গ জ্বলে, সিলেট ২০০৭, : মরমী কবি শিতালং শাহ, ঢাকা ২০০৫
মুহম্মদ এনামুল হক : —– সূফী প্রভাব, ঢাকা ২০০৬
সৈয়দ মোস্তফা কামাল : সিলেটের মরমী সাহিত্য, লন্ডন ১৯৯৮
হরেন্দ্র চন্দ্র পাল : পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, কলিকাতা ১৩৬০